মেসবাহ

কথাসাহিত্যিক দিলারা মেসবাহ

সমকলীন বাংলাসহিত্যে এক অনন্য নাম কথাশিল্পী দিলারা মেসবাহ।
দীর্ঘ চার দশক পেরিয়ে তিনি লিখছেন গল্প-উপন্যাস ও শিশুতোস
প্রন্থ। তাঁর লেখায় সুন্দর-সাবলিল আনন্দ আলোকে চিত্রায়িত হয়।
আমাদের বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন, ঘর-সংসার, মুক্তিযুদ্ধ
এবং আমাদের যাপিত-জীবনের নানান খুটি-নাটি বিয়ষ যা আমাদের
অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয় না। তার কথাসাহিত্যের নির্মানশৈলী, বিবরণ
ও চিত্রায়ণ আমাদের বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে নিজস্ত বৈভাবে।
কথাশিল্পী দিলারা মেসবাহর জš§ ২৮ আগস্ট, ১৯৫০। পিতা তাসাদ্দুক
লোহানী (শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক) মা-বদরুন নাহার লোহানী কণা ভাষা
ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সভাপ্রধান,
বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ। প্রকাশিত গ্রন্থ ৪০ টি। পুরষ্কার ও সম্মাননা ১৮টি।
‘গল্পকার’ মিনি ইন্টারভিউ কথাসাহিত্যিক দিলারা মেসবাহ
গল্পে যা বলতে চাই তা হুবহু লেখা সম্ভব হয় না,
প্রায়শ। কিছু বিষয় ‘নাজেল’ হয় অবচেতনের
তাড়নায় বা চেতনের তর্জনী গর্জনেÑদিলারা মেসবাহ
পদক্ষেপ কথাসাহিত্য পদক, কমর মুশতারী স্মৃতি
পদক, রাইটার্স ক্লাব শিশুসাহিত্য পুরষ্কার, নূরজাহান
কথাসাহিত্য পদক, তাইবুন নাহার রশিদ স্বর্ণপদক,
রত্নগর্ভা মা (আজাদ প্রডাক্ট) ছাড়াও আরো অনেক
সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি।
প্রকৃতি পাঠ একান্ত প্রিয় বিষয় তাঁর। সামাজিক
কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন । প্রান্তিক জনমানুষের
জীবন যাপন তাঁকে বিশেষ ভাবে আলোড়িত করে
বিধায় সেই সব দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের দিকে
দৃষ্টি রাখতে চেষ্টা করেন। ‘গল্পকার আয়োজিত মিনি ইন্টারভিউতে,
এবারের কথাশিল্পী ‘দিলারা মেসবাহ’।
গল্পকার: আপনি কেন লিখেন?
দিলারা মেসবাহ: কেন লিখি এর সোজা সাপটা জবাব নিজেও কি জানি?
বলতে পারি লিখি ভেতরের লালিত তাগাদায়, লিখি কিছু পাঠক পাঠ
করবেন, এমন অন্য রকম আশায়। এসবই ব্যক্তিগত অভিমত। আরও
যদি বলি আমাদের কৈশোর কাল কেটেছে সাহিত্য সংস্কতির আবহে।
মনে মনে বুঁদ হয়ে থাকতাম। প্রকাশ্য কার্যক্রম আশানুরূপ বেগবান
নয়। বাবা তাসাদ্দুক লোহানীর অনুবাদ গ্রন্থটি আমার কৈশোরের অপার
ভালোলাগা এবং কিঞ্চিৎ ‘ইর্ষা’র কেন্দ্রবিন্দু ছিল। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী
আবুল কাশেমের আঁকা ঝকঝকে রূপকথার মায়াপুরী বইটির প্রকাশ
কাল ১৯৫৬।
গল্পকার: আপনি গল্পে যা বলতে চান তা কি পুরোপুরি বলতে পারেন?
যদি না পারেন, তাহলে তার কারণ কি?
দিলারা মেসবাহ: গল্পে যা বলতে চাই তা হুবহু লেখা সম্ভব হয় না,
প্রায়শ। কিছু বিষয় ‘নাজেল’ হয় অবচেতনের তাড়নায় বা চেতনের
তর্জনী
গর্জনে। ধরুন অনেক গুলো গালি গালাজ জিহবার ডগায় সরসর করছে,
কিন্তু চেপে যেতে হয়! ছাপার অক্ষরে সেগুলো উগরানো ঠিক নয়।
সংসার সমাজ ছিঃ ছিঃ করবে। তবে
কেউ তো সাহস রাখে! সেখানের শিল্পগুণ থাকা চাই। আরোপিত রগরগে
সস্তা নড়বড়ে পরিবেশনায় কৃতিত্ব নেই। তৃতীয় শ্রেণির হাততালিতে সব
লেখক আগ্রহী নন। নান্দনিক আড়ালে জীবন চিত্র আরও
অধিক জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। বাংলা সাহিত্যে অজস্র
নমুনা আছে। রবীন্দ্রনাথ জীবন থেকে সরে গিয়ে অমর
রচনাগুলো লিখেছেন? কিঞ্চিৎ দোদুল্যমান আবডালে
যাপনের গুঢ় চিত্রলিপি বোদ্ধা পাঠককে আরও বেশি বিমুগ্ধ
করে। চেতনায় প্রজ্জ্বলিত করে বিচিত্র বোধ, গভীর দর্শন।
গল্পকার: কিভাবে লিখলে আপনার চিন্তার পূর্ণ প্রতিফলন
ঘটবে বলে আপনি মনে করেন?
দিলারা মেসবাহ: কঠিন প্রশ্ন বটে। কোন নিবেদিত প্রাণ
লেখক বা যে কোন মাধ্যমের শিল্পী যখন সৃষ্টির নেশায় আক্রান্ত
হন, তখন তিনি তাঁর সবটুকু শ্রম মেধা তাঁর আরাধ্য সৃষ্টির
মাধ্যমে প্রকাশ করতে আইঢাই করতে থাকেন। বিস্তর পাঠ, চর্চা
সর্বোপরি পরিশ্রমে আলোর মুখ দেখেন বা প্রত্যাশি হন। চড়াই
উৎরাই পার হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে অনেক ক্ষেত্রে। মনে
করি বেগবান মস্তিস্ক, কলমের ধার, লাগাতার পরিশ্রম ও দরদী
নিষ্ঠার পরিপূরক নেই বললেই চলে। এই সকল বোধি কে না
প্রার্থনা করেন! ভাগ্য কি সহজে সুপ্রসন্ন হয়। কিছু ছিটেফোঁটা
পেলেও রক্ষা।
গল্পকার: গল্পে শিল্প-প্রয়োগ শৈলী নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
দিলারা মেসবাহ: সাহিত্য শিল্প গুণান্বিত হবে এটি সহজ সত্য।
তবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ জহুরি চোখ চাই। শিল্পের কলা কৌশল
শৈল্পিক সৃষ্টির কারিশমা সর্বদাই পলাতকা ছায়া ফেলে বন
হরিনীর মতো নিজেকে অধরা করে রাখতে পারঙ্গম। তাকে
সাধন ভজনের তরিকায় বাঁধা চাই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
বহুকালের সঞ্চয়। সাহিত্যে বাক পরিবর্তন ঘটে। ভাষা, সময়ের
ব্যবধানে, দেশ কাল পাত্র বিবেচনায় সাহিত্যও রঙ বদলায়।
কিন্তু চিরন্তন সাহিত্য অমর। মানব আত্মার মোহনায় চির
দেদীপ্যমান।
গল্পে ছায়া পড়ে জাদুবাস্তবতার, মিথ, লোকাচার ইত্যাদি বিষয়ে।
এখানেও প্রশ্ন সঠিক মশল্লায় সার্থক কাহিনি স্বাদু, গুণান্বিত
‘গল্পকার’ মিনি ইন্টারভিউ কথাসাহিত্যিক দিলারা মেসবাহ
হয়েছিল? আবার সরল বর্ননারীতিতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়েও হৃদয়গ্রাহী
সার্থক গল্প লেখা যায়। যেমন বিভূতিভূষণ লিখেছেন।
আবার শহীদুল জহির জাদুবাস্তবতার নিরিখে লিখেছেন দাঁড়কাক
ও কাঠুরের গল্প। আরও প্রচুর গল্পের কাঠামোগত বৈশিষ্টের নমুনা
রয়েছে। খ্যাতিমান লেখকদের সৃষ্টি নিজস্ব স্বকীয়তার পরিচায়ক।
তাঁদের ভাষাভঙ্গি, শৈল্পিক কৌশল স্বতন্ত্র ধারার সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সাহিত্যের অনুকূলে বিশ্ববাতায়ন খোলামেলা থাকা শ্রেয়। তবে এটাও
কি অনুচিত নয় বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য গৌরব অগ্রায্য করার প্রবণতা?
একজন কথাশিল্পী বিশ্বসাহিত্যের পাশে নিজস্ব সাহিত্যের ঐতিহ্যের
ধারাটি বেগবান রাখার বিষয়টি অনুধাবণ করবেন। বাংলাদেশ স্বাধীন
হয়েছে। সমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতার পাশে
নবীন। তারপরেও
কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম তৈরি হচ্ছে। সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনের যাত্রায়
শৈল্পিক বুননকৌশল, ভাবনার বিষয়াদি নতুন রূপ নিতে পারে। তবে
কালের বিবেচনায় দোদুল্যমান থাকে তার আয়ুষ্কাল। নতুন শব্দ নতুন
দর্শন ভিন্নতর যাপনের বৈশিষ্ট্যের চিত্রলিপি প্রতিভাত হয়। সাহিত্য
চিরকাল সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবনার প্রতিফলন ঘটায় নানা ব্যঞ্জনায়। মহত
কথাসাহিত্যের আবেদন চিরকালীন।
গল্পকার: আপনি গল্পে যা বলেন তা মানব কল্যাণে কতোটা কাজে
লাগে বলে মনে করেন?
দিলারা মেসবাহ: স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের একরকম আনন্দে গল্প লিখি।
মানব কল্যাণের বৃহত্তর প্রেক্ষিত তখন বিবেচনায় আলাদা চিন্তাসূত্র
তৈরি করে না। তবে অকল্যাণের ভাবনা নিশ্চয়ই
থাকে না।
আমার গল্পে মোটের উপর ভালোবাসার কথা থাকে।
সুর মিলাতে চাই–মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
সেখানেই সকল সিদ্ধি প্রাপ্তিযোগ। কোন কোন সার্থক
গল্পের রস্মি পাঠকের জীবন বদলে দিতে পারে।
আমার গল্প পাঠ করে কে কতটুকু প্রাণিত হয়েছে
সে বিষয়ে আমার স্বচ্ছ ধারণা নেই। কিন্তু আমার গল্প
‘গল্পকার’ মিনি ইন্টারভিউ কথাসাহিত্যিক দিলারা মেসবাহ
পড়ে কেঁদেছে বা কারো ভালো লেগেছে, এ ধরনের
যতকিঞ্চিৎ আলাপ শুনেছি। কিছুটা নিরিবিলি স্বভাবের
দোষে পাঠকের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে
পিছিয়ে আছি হয়তো।
গল্পকার: আপনার লেখা নিয়ে পাঠকের মতামত
কিভাবে দেখেন?
দিলারা মেসবাহ: পাঠকের মতামত অবশ্যই
গুরুত্বপূর্ণ, আর যদি তিনি হন বোদ্ধা পাঠক। তাঁদের
আলোচনা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। মনে
করি এতে ভালো মন্দের স্বচ্ছ ধারণা জšে§। গঠনমুলক সমালোচনা
গুরুত্ব দেয়া শ্রেয়।
গল্পকার: বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে আপনার প্রিয় লেখক কে? কেন?
দিলারা মেসবাহ: বাংলাদেশের গল্পকারদের অনেকের ভক্ত পাঠক
আমি। প্রিয় লেখক হিসেবে কোন নামটি উচ্চারণ করা যায়, দ্বন্দ্বে
পড়ে যাই। তারপরও এই মুহূর্তে মনে পড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,
হাসান আজিজুল হক, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, নাসরিন
জাহানের নাম। কেন? এর উত্তর লম্বা চওড়া। জীবনের জলতরঙ্গ হুবহু
এঁদের রচনায় যেন বেজে চলেছে। সমাজ সংসার ইতিহাস রাজনীতির
চিত্র বিবিধ বিভঙ্গে প্রতীয়মান হয়। চেতনা স্বচ্ছ সমৃদ্ধ হয়। কখনও
মনে হয় এ কাহিনি আমারই। অজানা অচেনা কোনো কোনো চরিত্র
বিপুল বিস্ময়ে সামনে দাঁড়ায়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা অদ্ভুত জাদুবাস্তবতার বিভ্রমের
ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ে চলে আশ্চর্য জাদুকরী ভবসংসারের
কোলাহলে। দুধভাতে উৎপাতে ডুবে গেলে ডাঙ্গা খুঁজে পাইনা। অবাক
জীবন বোধের কপাট খুলে যায়–! হায় জীবন। চেতনায় নাম না জানা
ঢেউ খেলে। হাসান আজিজুল হকের গল্প পাঠ অবিনাশী জীবন পাঠের
নামান্তর। শকুন গল্পে রাঢ় বঙ্গের নির্মম বাস্তবতার চিত্র। দেশভাগের
বেদনার অপার মহিমা তাঁর আগুনপাখি উপন্যাসে।
রিজিয়া রহমানের বাঘবন্দি অবিনাশী সাহিত্য। তাঁর রক্তের অক্ষর
থেকে বহু উপন্যাস উচ্চামার্গের রচনা। ছোট গল্পে তিনি অসাধারণ।
‘গল্পকার’ মিনি ইন্টারভিউ কথাসাহিত্যিক দিলারা মেসবাহ।

সেলিনা হোসেন, নাসরিন জাহান প্রমুখ লেখক ছোট গল্পের ভুবনে
অনিবার্য। এই স্বল্প পরিসরে অনেক প্রিয় গুণী লেখকের সাহিত্য কর্ম
বিষয় অলিখিত রইল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বেশ
কিছু সাহিত্য গুণান্বিত গল্প রচিত হয়েছে। নতুন প্রজšে§র মেধাবী
লেখক আত্মপ্রকাশ করছেন বটে।
গল্পকার: বাংলা ভাষার একমাত্র গল্পবিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘গল্পকার’
দশম বর্ষ উদযাপন করছে। একটি সাহিত্য পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ ও
টিকে থাকার সংগ্রাম ও অন্তরায় নিয়ে আপনার মন্তব্য।
দিলারা মেসবাহ: গল্পকারকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। এই পত্রিকাটি
বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদের পাশাপাশি মানসম্মত গল্প ইত্যাদি প্রকাশ
করে থাকে। সমৃদ্ধ আয়োজন। বেগবান হোক আগামী পথচলা। ১০
বছরের অভিজ্ঞতা অমূল্য। গল্পকারের জয় হোক। আশীর্বাদ অজস্র।
এর কার্যক্রম প্রণিধান যোগ্য। বিবিধ আয়োজনে শিল্প সাহিত্যের
ঐতিহ্য গৌরব ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে গল্পকার। মূল কারিগর ও
সাথে যাঁরা রয়েছেন সবার জন্যে অশেষ শুভকামনা।
গল্পকার: লেখালেখি নিয়ে আপনার স্বপ্ন –
দিলারা মেসবাহ: কোন বিশেষ স্বপ্ন জমতে থাকে করোটির ভাঁজে।
কিন্তু সেটি প্রকাশ করায় বিপত্তি। জীবনের চড়াই উৎরাই পার হতে
হতে সন্ধ্যা
ঘনিয়ে আসে বৈকি। আফসোস, জীবন এত ছোটো কেনে! ভালো
কাজ করার স্বপ্ন সাহিত্য বিষয়ে অবচেতনে সুখে থাকুক।
ইচ্ছে আছে মহীয়সী নারীদের নিয়ে কিছু কাজ করব। বারবার নানা
কিসিমের বাধা আসে। ছোটদের জন্যে কিছু কাজ করব। সময় এত
সংক্ষিপ্ত! তবে স্বপ্নের হাত ছাড়তে চাই না। ছোটগল্প মুলতঃ আমার
ভালোবাসার জায়গা। আরও কিছু লিখে যাবার সৌভাগ্য যদি ঘটে!
এভাবেই আশা নিরাশার দোলাচালে প্রতিদিন যাপন করি। সৃজনশীল
বেঁচে থাকা একান্ত মধুর এবং কাম্য।