দরজায় কয়েকবার টোকা পড়ার শব্দে মাঝরাতে চোখে লেগে
আসা ঘুম ভেঙ্গে গেল। এমনিতেই সপ্তাহ ধরে নিয়মিত
রাতে ঘুম হচ্ছেনা আর এখন আসতে যাওয়া ঘুমটাই ছুটে গেল।
জানালার টানা পর্দার আড়ালে করিডোরের বাতির আবছা আলো
ঘরে। মাহফুজ চোখ কচলে বালিশের পাশে থাকা মুঠোফোন
দেখল। রাত দু’টো বেজে পঁয়ত্রিশ। পূনরায় দরজায় টোকা
পড়ছে। মাহফুজ দরজার কাছে যাবে কি যাবে না ভাবছে।
হোটেল ঘর।
মাহফুজ শুনেছে অনেক হোটেলে রাত-বিরেতে কলগার্ল এসে সর্বশান্ত
করে যায়। তেমন কেউ এলো কিনা- বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ঝামেলা
আঁচ করে মাহফুজ।
কলকাতার মারকুয়িস্ট স্ট্রিটের হোটেল কমফোর্ট হোমের তিনশত এগার
নাম্বার ঘরে চৌদ্দ দিন ধরে থাকছে বাংলাদেশের বগুড়ার আদমদীঘী
থেকে আসা মাহফুজ। থাকছে বললে অনেকটা ভুল হবে। বলতে হবে
মাহফুজ কলকাতায় আটকে আছে। তার আটকে থাকার গল্পে আসছি।
আগে দরজার বাইরে অপেক্ষমান মানুষটির খোঁজ নি।
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দরজায় টোকা পড়ে যাচ্ছে। মাহফুজ দরজার
কাছে এগিয়ে গেল। গভীর রাতে নিচু স্বরে আওয়াজ করলেও অনেক
উচ্চু আওয়াজ মনে হয়।Ñকে?
প্লিজ দরজা খুলুন। দাদা-প্লিজ দরজা খুলুন। আমি বিপদে পড়েছি।
মেয়েলি এমন কথা শুনে থমকে দাড়াঁলো মাহফুজ। ভাবল-তাহলে তার
ধারনাই সঠিক। হোটেরে রাত-বিরেতে কলগার্লের পাল্লায় পড়েছে সে।
দরজার কাছে চুপকরে দাঁড়িয়ে থাকে মাহফুজ। কোন শব্দ করে না।
দাদা প্লিজ দরজাটা খুলুন। মায়ের দিব্যি, ভগবানের দিব্যি বলছি।
আপনার কোন ক্ষতি হবে না। আমাকে একটু সাহায্য করুন। বলল
দরজার ও পাশের মেয়েটি।
দরজা খোলার জন্য ছিটকিনিতে হাত দিয়েও ফিরিয়ে নেয় মাহফুজ।
ভাবে-এটা কোনো ব্লাকমেইল নয়তো। চোরের কাছে ধর্ম কি আর
ভগবান কি।
আপনি নিচে রিসেপশনে যান। ওখানে লোক আছে। বলল-মাহফুজ।
মাহফুজের ঘরেও রিসেপশনে যোগাযোগের ফোন নেই।
না দাদা। এখন রিসেপশনে গেলে আমার বিপদ হবে। আমাকে তিন
চার ঘন্টা আশ্রয় দিন। ভোর হয়ে এলেই আমি ফিরে যাব। মায়ের দিব্যি
বলছি আপনাকে বিপদে ফেলবনা। দাদা-প্লিজ।
খটাস করে দরজার ছিটকিনি খুলল মাহফুজ। এক ঝটকায় দরজা ঠেলে
মাহফুজের গায়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকলো মেয়েটি। মাহফুজ
সরে দাড়াঁতে মেয়েটি নিজেই ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। ঘরে আলো
জ¦ালাতে সুইচর্বোডে হাত দিতে গেলে মাহফুজের হাত ধরে আটকে
বালিশ হেলান দিয়ে বসল মাহফুজ। আবছা আলোয় শ্যামলা
গড়নের মেয়েটির মুখ দেখে অনুমান করা যায় বয়স আনুমানিক
তেইশ-চব্বিশ। মোটামুটি মাঝারি দেহের গড়ন। চুল খোলা।
কাঁধে ওড়না ঝোলানো হাস্নাহেনার মতো ঘ্রানের পারফিউমের
তাড়না বুঝা যাচ্ছে।
মাহাফুজের মুখে কথা নেই। ভয়ে চুপসে আছে। মেয়েটি হাত
ব্যাগ থেকে একটি মুঠোফোন বের করে সুইচ অফ করল।
মুঠোফোনের এক ঝলক আলোতে মেয়েটির মুখাবয়ব দেখা
গেল। ভালোই। সুন্দর। মায়া আছে চেহারায়। ঠোটে লিপিস্টিক।
এভাবে পরপর তিনটি মোবাইল সুইচ অফ করে ব্যাগে রাখলো।
জল হবে? বলল মেয়েটি।
হুম। ঐ যে; মেয়েটির পায়ের কাছে মেঝেতে থাকা
জলের বোতল দেখিয়ে দিল মাহফুজ।
বোতল নিয়ে ঢকঢক করে গলায় জল ঢালল।
তারপর বিছানায় পা তুলে আরাম করে বসল।
বাংলাদেশ? মেয়েটি শুনতে চাইল।
হুম। ভয়ে কাচুমাচু মাহফুজ। কোন বিপদে পড়ল
আল্লাহই জানেন।
ঘুরতে এসেছো? পুনরায় মেয়েটি বলল।
না। কাজ।
তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। এতো রাতে কেন
ডিস্টার্ব করলাম সেটাই বলি।
হুম। মাহফুজ হ্যা-হুম ছাড়া কিছুই বলতে পারছে না।
দেখেই বুঝতে পারছ আমি কলর্গাল।
বেশ তো এমন হাতের কাছে পেয়েও নিতে চাও না। অবশ্য
পূরুষদের আমি বিশ্বাস করিনা। সুযোগ পেলে এরা গাছেরটাও
খায় তলারটাও কুড়োয়। যাক। যে কথা বলছিলামÑ তিনশত
তের নাম্বার ঘরের ঐ হারামজাদা আমাকে রেট ঠিক করে আনল।
বলেছিল সে একাই। ওমা ঘরে এসে দেখি তিন ভালুক। কালো
লোমশ হাত-পা আর বুকের নিচে ঝুলে থাকা তিন তিনটে পেট।
তিনজন দেখেই তো মাথায় রক্ত উঠে গেল, রাগারাগি করে
রেরিয়ে গেলে বিপদ। হোটেলে ঢুকেছি যখন রিসেপশনের ঐ
ছেলেকে পাঁচশত টাকা দিয়ে বেরুতে হবে। সাতে তো তার
টাকা নিয়ে আসিনি। তাই ঘঠনাটা ঘঠালাম।
ঘটনা ঘটানোর কথা শুনে ভয়ে কুঁচকে গেল মাহফুজ। মেরে
টেরে দিল নাকি?
আরে ভয় পেয়োনা, মেরে দি নাই, সব জায়গায় আমরা
নিজেদের প্রোটেকশান নিয়েই যাই। যখন দেখলাম তিনজন
আর তিনজনই মরিয়া তখন জলের বোতলে জিনিসটা মিশাইয়া
দিলাম। ব্যাস। কারণ তিনজনের লগে তো আমি পারুম না।
কি কও? মাহফুজের চোখের দিকে ইঙ্গিত করেই বলে মেয়েটি।
পরক্ষণে নিজেই উত্তর দেয় তোমারে জিগাইয়া লাভ নাই।
শোন। আমার লগে ঠাট্টা তামাশা কইরা নাসতা খাইলো। তারপর
জল। কিছুক্ষন পর একজন একজন নিজ থেইকাই শুইয়া পড়ল।
তাঁরপর! অস্পষ্ট স্বরে মাহফুজের মুখ থেকে বের হলো।
তারপর আর কি! ওদের মোবাইল টাকা যা ছিল সব নিয়া আউট।
কিছুক্ষণ দম নিয়ে বললÑশোন,আমি কলগার্ল হতে পারি, কিন্তু
বেঈমান না। একজনের কথা বইলা আইনা তিনজন! শিক্ষাটা
দিলাম।
হোটেলের গেট বন্ধ। ছোকরারে জাগাইলে সেও সন্দেহ করব।
ইতোমধ্যে মাহফুজের মনে ভরসা জাগে যে মেয়েটি অন্তত
তার কোন ক্ষতি করবেনা।
মেয়েটি বিছানায় দু’পা তোলে বালিশে হেলান দিয়ে এমন
ভাবে কলা-পাউরুটি খাচ্ছে যেন এটা তার শোবার ঘর। আর
আমি তার স্বামী গোত্রিও কেউ।
এই তিন-চারটা ঘন্টা তোমার লগে থাকি। আর… । থামে
মেয়েটি
মাহফুজ চুপচাপ।
আর তুমি ইচ্ছা করলে টেস্ট করতে পার। টাকা লাগবো না ।
টাকা অনেক পাইছি।
মাহফুজের মুখ থেকে কোন কথা বেরোয় না।
আচ্ছা থাক! তুমি কি ঘুমাইবা? ঘুমাইলে ঘুমাও।
যাইবার কালে আমি ডাইক্যা দিমু। নাহ। ঘুমাবো না।
আচ্ছা।
কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটে। বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হয়
বৃষ্টি হচ্ছে।
তোমার ঘরে খাবার কিছু আছ? জেগে থাকলে আমার ঘনঘন
খিদে পায়।
হুম, আছে, আলো দি? মাহফুজ বলল।
না আলো দিতে হবে না। তুমি খাবার কি আছে দাও, জানালার
পর্দাটা কিছুটা সরিয়ে নেয় মেয়েটি। ঘরটি আরো বেশি
আলোকিত হয়।
বিছানার পাশে বসে কলা-পাউরুটি দেখিয়ে দেয় মাহফুজ।
মেয়েটি নিয়ে খেতে খেতে কথা বলে।
ইতোমধ্যে মাহফুজের মনে ভরসা জাগে যে মেয়েটি অন্তত তার
কোন ক্ষতি করবেনা।
মেয়েটি বিছানায় দু’পা তোলে বালিশে হেলান দিয়ে এমন ভাবে
কলা-পাউরুটি খাচ্ছে যেন এটা তার শোবার ঘর। আর আমি
তার স্বামী গোত্রিও কেউ।
বলেছিলে কাজে এসেছো। তো কি কাজ? ব্যবসা? না অন্য কিছু?
মেয়েটি জানতে চাইলো।
আয়ারল্যান্ডের ভিসা প্রসেসিং এর কাজে এসেছি।
ও। আয়ারল্যান্ড যাবে? বেশি টাকার চাকরি?
সে ইচ্ছায় তো আসা।
তোমার দেশে আয়ারলান্ডের এম্বেসি নেই?
থাকলে তো আর এখানে এসে হোটেল বাস করতে হতো না।
তা বেশ বলেছ। তো পাসপোর্ট-কাগজ জমা দিয়েছ?
দিয়েছি আজ চৌদ্দ দিন পেরিয়ে গেল। সাধারণত এম্বেসি দুই
সপ্তাহের মধ্যেই ভিসা দেয়। কিন্তু এখনো কোনো খবর এলো
না। শুনেছি কখনো কখনো মাস দু’য়েকও লেগে যায়।
বুঝতে পারছি টেনশনে আছো। বাড়িতে কে কে আছে? মেয়েটি
বলল।
মা, ছোটবোন, বাবা, করোনায় চলে গেলেন। অবশ্য তার
শ্বাসকষ্ঠ আর ঠান্ডাজনিত সমস্যাও ছিল।
ছোটবোন কলেজে পড়ছে। ওর বিয়ের কথা-টথা হচ্ছে। গ্রামে
থাকলে যা হয়Ñ মন খুলে কথাবলার একজন মানুষ পেয়ে ভালোই
লাগছে মাহফুজের। গত চৌদ্দ দিন কলকাতার মারকুয়িস্ট
স্ট্রিট, মীর্জা গালিব স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট আর নিউমার্কেট এলাকা
চষে বেড়াচ্ছে। একা একা ঘুরছে। বেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া
হোটেলে রাত-যাপন।
মা বোন রেখে তুমি আয়ারল্যান্ড গেলে তাদের দেখবে কে? বলল
মেয়েটি। পাউরুটি কলা খাওয়া চলছে। এনিয়ে দ্বিতীয় কলা
সাবাড় হচ্ছে।
তাদের ভালো থাকার জন্যই তো আমার আয়ারল্যান্ড যাওয়ার
চেষ্টা। দেশে ভালো চাকরি নেই। ব্যবসা করার পুঁজি নেই।
আমাদের মতো বেকার যুবকদের দেশ ছাড়ার বিকল্প কী আছে?
দীর্ঘশ্বাসে বলল মাহফুজ।
তুমি ঠিকই বলেছ। এদেশের অনেক যুবক এখন ইউরোপ
আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে। চাকরি নেই। ঘুষ। দূর্নীতি,
স্বজনপ্রীতি সবই আছে।
হুম। আমরা অনেক্ষণ কথা বলছি কিন্তু আমাদের নাম জানাজানি
হলো না।
আমি রিয়া। কলেজে সেকেন্ডারি পাশ।
অবাক হয়ে তাকায় মাহফুজ। আবছা আলোতে ঠিক বুঝা
যায়না। তারপর বলেÑআমি মাহফুজ।
গ্রেজুয়েশান শেষ করেছি।
কলেজে সেকেন্ডারি শেষ করে তুমি…? বলল মাহফুজ।
শোন এই পেশায় আসা সব মেয়েদেরই একটি গল্প থাকে।
বেশির ভাগ গল্পই একি রকম। কোনো এক পূরুষের প্রতারণা।
বিশ্বাসকে ভেঙ্গে চুরমার করা, ইত্যাদি ইত্যাদি বলল- রিয়া।
হুম একদম।
আমারও বাসায় মা আছে। ছোট ভাই-বোন আছে। বাবা বলে
যিনি ছিলেন- তিনি স্বেচ্ছায় আরেকটি পরিবার করে নিয়েছেন।
সেখানেই তার নতুন সংসার, আর আমরা আমাদের মতোই,
ছোটদের জন্যই আমাকে আয় করতে হয়। সে যাক। আমি
এসব কথা বলতে চাই না। কথায় অনেক কথা আসে।
হুম।
রিয়া চুপচাপ। মাহফুজের ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের চোখেই মাহফুজ
বললÑ আচ্ছা ওদের যদি জ্ঞান ফিরে আসে ওরা যদি তোমায়
খোঁজ করে। রিসেপশনের ছোকরা যদি বলে দেয় তুমি বেরিয়ে
যাওনি। তখন?
আরে। অতো চাপ নিওনা তো, পাঁচ-ছয় ঘন্টার আগে ওদের
জ্ঞানই ফিরবেনা। আমি ডোজ ওভাবেই দিয়েছি। বলল রিয়া।
রিয়া উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগ বিছানায় রাখা। ওয়াশরুমের দিকে
যেতে যেতে বলে তোমার ওয়াশরুম ইউজ করি। বলেই আলো
জ¦ালিয়ে ঢুকে পড়ল।
মাহফুজ বিছানায় বালিশের সাথ আধশোয়া। ঘুম জড়ানো চোখ।
এর মধ্যে ভাবছে-রিয়া ইচ্ছে করলে ওর টাকা মুঠোফোন সব
নিয়ে যেতে পারে। চাইলেই হাতে তুলে দেয়া ছাড়া কোনো গতি
নেই মাহফুজের। ভোর হয়ে এলো।
রিয়ার ডাকেই ঘুম ভাঙল মাহফুজের, বালিশে হেলানো অবস্থায়
ঘুমিয়ে পড়েছিলে। রিয়ার ডাকে হকচকিয়ে জেগে বসে। ঘুমের
ঘোরেই মাহফুজ বলে-মায়া বিরক্ত করছিস কেন?
মায়া কে? জানতে চায় রিয়া।
ছোটবোন, উত্তর দেয় মাহফুজ, কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
ও আচ্ছা। শোন, আমার যাবার সময় হয়ে গেল। আমার
মোবাইল নাম্বার সেভ করে রাখো, যে কোনো প্রয়োজনে ফোন
দিও। তুমি যেমন আমার বিপদে সাহায্য করেছ আমিও তোমার
কোনো প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারি। বলল-রিয়া।
বাইরে ভোরের আলো বাড়ছে। ইতোমধ্যে ওয়াশরুমে গিয়ে
ফ্রেশ হয়ে এসেছে রিয়া। ঠোটে লাল লিপিস্টিক। হাতে চুড়ি।
আর জামা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে হাস্নাহেনা পারফিউমের ঘ্রান।
দরজা খুলে বেরিয়ে দেখ করিডোরে কেউ আছে কিনা? বলল রিয়া।
মাহফুজ রিয়ার কথা মতো বেরিয়ে দেখল। না। কোথাও কেউ নেই।
রিয়া বেরুল। করিডোরের শেষপ্রান্ত উপরের ঝুলানো সিসি
ক্যামেরা দেখিয়ে বললÑঐ যে ক্যামেরা দেখছ, তোমার ঘরে
ঢোকার আগে আমি ওটার তার কেটে দিয়েছি। যাতে আমি
কোন ঘরে ঢুকছি সেটা ওরা বুঝতে না পারে, তোমার কোনো
সমস্যা নেই।
হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে প্যাঁচানো সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল রিয়া।
মাহফুজ দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় ফিরল। চারদিকে
রিয়ার হাস্নাহেনা পারফিউমের ঘ্রান এখনো ছড়িয়ে আছে। আলো
জ¦ালিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। কাজ সেরে মুখ জল দিতে লুকিং গ্লাসে
দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল স্ট্যান্ডে লিপিস্টিক রেখে গেছে রিয়া।
চোখ-মুখে জলদিয়ে বিছানায় ফিরে মাহফুজ।
ইতোমধ্যে আরও ছয়দিন পেরিয়ে যায়। ভি এফএস গ্লোবালে
মাহফুজের পাসর্পোট জমা দেয়ার কুড়ি দিন পেরিয়ে গেল।
বাড়িতে মা অসুস্থ। ছোটবোন মায়াকে কলেজে যেতে হচ্ছে।
মাকে দেখতে হচ্ছে, টিউশন করে নিজের এবং কখনো কখনো
বাসার বাড়তি খরচও সামলে নিতে হচ্ছে। বাবার পেনশনের
অল্প ক’টি টাকায় তিনজনের ছোট সংসার চলে না বললেই হয়।
মনে পড়ে লুনার কথা। মায়ার সহপাঠি। এই সময়ে আর
প্রেমিকার কথা ঘটা করে মনে করতে হয় না। মুঠোফোনের
সুবাদে মূহুর্তেই যোগাযোগ হয়। কথা হয়। মান-অভিমান হয়
প্রায় চার বছরের প্রেম তাদের। প্রয়োজনে-আপ্রয়োজনে কথা
হয়। তারপর পারস্পারিক ভালোলাগা। এবং সেই ভালো
লাগাটাই দিন দিন বাড়তে থাকে।
লুনা বারণ করেছিল। তোমার বিদেশ যাওয়ার দরকার নেই।
তোমাদের ছোট সংসার। ভিটে-মাটি যা আছে ওতে সংসার
চলে যাবে। তাছাড়া চাকরি না জুটলেও হাতের কাজের ছোট্ট
কোনো ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে..। লুনার স্বপ্নে মনের গহীনে হাসে
মাহফুজ। নিজের দু’পায়ের উপর ভরসা পায় না। অসময়ে
হঠাৎ বাবা চলে যাওয়ায় যেন ভয়টা অধিক পেয়ে বসে তাকে।
ইউরোপের কোনো একটি দেশে যেতে পারলেই কম সময়ে
পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারবে। হাজারো যুবকের
মতো মাহফুজের বিশ্বাস।
দু’সপ্তাহের অর্থবল নিয়ে কলকাতা আসা মাহফুজের হোটেল বাস
মাস পেরুতে চলল। কৃচ্ছতার সর্বোচ্ছ পর্যায়ে থেকেও পকেটের
টাকা ফুরিয়ে আসে।
হোটেল ছাড়তে বাধ্য হয় মাহফুজ। পকেটে মাত্র সাত’শ
পয়তাল্লিশ রুপি। কাধেঁ ঝোলানো ব্যাগ। দেশে ফেরার পাসর্পোট
নেই। কোথায় যাবে? কি করেবে? কিছুই মাথায় আসে না।
জীবনের এমন অসহায় সময়ে মায়ের মুখটি ভেসে ওঠে মাহফুজের
মনে। মারকুয়িস্ট স্ট্রিট পেরিয়ে মীর্জা গালিব স্ট্রিট। মানুষের
স্বাভাবিক যাপিত জীবণ। প্রত্যেক মানুষ তার নিজ নিজ কাজ,
গন্তব্যে আর হয়ত কোনো এক মোহের পেছনে ব্যস্ত। মাহফুজ
হাঁটছে। পীচঢালা কালো পথ। আশ-পাশ দোকান-দোকানি পথ
চারী, ছোট্ট মেটো কাপে চা পান, আকাশে বড় জায়গা দখলে
মাহফুজের মনে প্রতিধ্বনি তোলা কথাগুলোÑ‘আমার আয়ারল্যন্ড যাবার
দরকার নেই। ইউরোপের স্বপ্নীল জীবন চাইনা অতি অর্থ চাই না।
আমি শুধু মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাই। অসুস্থ মায়ের পাশে থাকতে
চাই’ Ñ বাতাসে দোলা খাওয়া গাছের পাতায় নীরবে ঝংকার তোলে।
নিয়ে বড় বড় ছাতিম গাছ। সবই মাহফুজের চোখে পড়ছে। কিন্তু কিছুই সে
দেখছে না। চোখের মনিতে আটকে আছে মায়ের অসুস্থ মুখ।
সরকারি অফিসের উচ্চমান সহকারী বাবার স্বল্প বেতনের সংসার কতোটা
আত্মসম্মানের সাথে মা টেনে নিয়েছেন। দিন-রাত ঘর-গেরস্থের কাজ নিয়ে
পড়ে থাকতো মা। কিভাবে দু’মুঠো চাল বাঁচবে, কিভাবে শাক-তরকারি
যোগাড় করে খরচ বাঁচাবে আর নিজে কম খেয়ে অথবা কখনো না খেয়ে
সংসারের অন্যদের পাতে ভালো খাবারটুকু তুলবে সে চেষ্টাই করতো মা।
আর সে মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। মাহফুজের চোখে জল নামে।
মায়ের জন্য কষ্ট হয়। মা…মা গো। খুব ডাকতে ইচ্ছে হয়। গলার ভেতরটা
আটকে আসে। আটকে থাকা কান্নায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। এসপ্লানেড
পেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটে এসে পড়ে মাহফুজ। রাস্তা পার হয়। পার্কের উল্টো
পাশে একটি সুন্দর-সবুজ খেলার মাঠ। দু’পাশে বড় বড় শিরিষ ও ছাতিম
গাছ। এক পাশে লোহার তৈরি বেঞ্চ। পথিকের বিশ্রামের জায়গা।
দুপুর গড়িয়েছে। পার্কের বেঞ্চগুলো শূন্য। একটি বেঞ্চের নিচে দু’টি
কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। রোদের তেজ এখনো কমেনি। গাছের
ছায়ার দিকের একটি বেঞ্চিতে গিয়ে ব্যাগ রেখে বসে মাহফুজ। গাল বেয়ে
পড়া চোখের জল শুকিয়ে আসে। কিন্তু মায়ের অসহায় মুখটা বারবার মনে
ঝড় তোলে। একবুক কষ্ট নিয়ে ভাবে তার আয়ারল্যান্ড যাবার দরকার
নেই। মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারলেই যেন স্বর্গসুখ। মাহফুজের মনের
ভেতরে মায়ের কাছে ফেরার আকুতি কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের সবুজ মাঠ
বড় বড় গাছপালা নীরবে অনুভব করে। মাহফুজের মনে প্রতিধ্বনি তোলা
কথাগুলোÑ‘আমার আয়ারল্যন্ড যাবার দরকার নেই। ইউরোপের স্বপ্নীল জীবন
চাইনা অতি অর্থ চাই না। আমি শুধু মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাই। অসুস্থ
মায়ের পাশে থাকতে চাই’ Ñ বাতাসে দোলা খাওয়া গাছের পাতায় নীরবে
ঝংকার তোলে। পার্ক স্ট্রিটের শুন্য উদ্যানে দাঁড়িয়ে মাহফুজের
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি আমার পাসর্পোট ফিরে
পেতে চাই। আমার দেশ-আমার স্বাধীনতা। আমার স্বাধীনতায়
ফিরে যেতে চাই। চোখে জলের বন্যা নামে। আবার। বারবার।
ঝিম ধরে বেঞ্চিতে বসেছিল মাহফুজ। মুঠোফোনে বেজে ওঠায়
সস্তি ফিরে পায়। লুনা ফোন করেছে। বেশি কথা হয়না। বলতে
ইচ্ছে করে না মাহফুজের। ‘মা হাসপাতালে’ শুধু এটুকু শুনেই
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে সূর্য। বিশাল শিরিষ গাছের ডাল
পালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে পড়ন্ত বেলার রশ্মি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সূর্যের তেজহীন আলো মাহফুজের মুখে এস পড়ছে। বাকরুদ্ধ
মাহফুজ বেঞ্চিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে।
মাকে নিয়ে হাসপাতালে লড়ে যাচ্ছে মায়া। লুনা সময়- সুযোগ
হলেই ছুটে গিয়ে পাশে থাকছে। মায়াকে সাহস দিচ্ছে।
মাহফুজের টেনশন বেড়ে যাবে ভেবেই মায়ের হাসপাতাল যাওয়ার
খবর জানায়নি মায়া। কিন্তু লুনা জানিয়েছে। সহযোগিতা করছে।
সেবা করছে। প্রেমিকের মায়ের এমন সঙ্কটাপন্ন সময়ে পাশে থ
াকার দায়িত্ববোধ লুনার প্রতি মাহফুজের আবেগ বেড়েছে শতগুন।
হঠাৎ হাউমাউ করেÑ মা গো, ওমা ডেকে চিৎকার করে কেঁদে
ওঠে মাহফুজ। দু’হাতে মুখ ঢাকে।
পাশের বেঞ্চের নিচে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমন্ত কুকুর দু’টি ঘেউ ঘেউ
করে জেগে ওঠে। আড়মোড়া ভাঙ্গে কিশোরের দল দূরে সবুজ
মাঠে ফুটবল খেলছে। তারা মাহফুজের স্বশব্দে কান্না শুনতে
পায়নি। কুকুর দু’টি মাহফুজের কাছে আসে ঘুর ঘুর করে।
ব্যাগের কাছে নাক এনে ঘ্রাণ নিতে চায়। ফ্যালফ্যাল করে
মাহফুজের দিকে তাকায়। মুখের ভেতরে রহস্যময় শব্দ করে।
গোঙ্গানি বলে মনে হয় না পূরুষ কুকুরটি মাহফুজের আশ-পাশে
ঘুর ঘুর করে। ঘেউ ঘেউ শব্দ করে। ক্ষীন স্বরে।
মাহফুজের কান্নার জোয়ার ভাটা পড়ে আসে। বিদেশের মাটিতে
নিঃসঙ্গ এমন দু:সময়ে কুকুরটিকেই বেশ আপন মনে হয়। তার
দুঃখ ভাগ করের নেয়ার জন্যই কুকুরটি ঘুরঘুর করছে। হয়তো
তাকে সান্তনা দিচ্ছে। জীবন এমনই। সময় জীবনকে কখন
কোথায় নিয়ে দাঁড় কারায় তা ঠিক সময়ও বলতে পারে না।
তারপরও বাঁচার মোহে ছুটে চলতে হয়। যেমন কুকুরেরা ছুটে
চলে। কুকুরটির দিকে তাকিয়ে মাহফুজের মনে হলোÑ এরা
কতো স্বাধীন। খাবারের খোঁজে ছুটে বেড়ায়। প্রকৃতি তাদের
খাবারের ব্যবস্থাও করে দেয়। তারপর সুবিধা মতো জায়াগা
পেলেই শুয়ে পড়ে, ঘুমায়। ওঠে। যেখানে ইচ্ছা প্রাকৃতিক কর্ম
সারে। আবার খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। ছুটে বেড়ানোর
কোনো সীমানা থাকেনা। কাঁটাতারের বেড়া মানতে হয় না।
পাসপোর্ট প্রয়োজন হয় না।
এ মূহুর্তে মাহফুজের নিজেকে কুকুরের চেয়েও অধম মনে হয়।
কারণ একটি পাসপোর্টের জন্যই সে আজ অন্য একটি দেশে
আটকে আছে। মূমুর্ষূ মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারছেনা।
শিরিষ গাছের আড়ালের সূর্য ডুবতে চলেছে। মাহফুজ
মানসিকভাবে শক্ত হবার চেষ্টা করে। ভেতরের মানুষটি দৃশ্যমান
মাহফুজকে প্রবোধ দেয়Ñ যা হবার তা প্রকৃতিক নিয়মেই হবে।
হা-পিত্যেস করে তো কোনো লাভ হবে না।
কুকুর দু’টি আর সে জায়গায় নেই, গেছে অন্যকোথাও।
একসাথে। মাহফুজ একা। এখন মাথা গোঁজার ঠাই চাই।
পকেটে সাতশত পঁয়তাল্লিশ রুপি। দুপুরে খাওয়া হয়নি। হোটেল
ছাড়ার সময় জলের বোতল সঙ্গে নিয়েছিল। জল পানেই এ পর্যন্ত
চলল। কী করবে? কোথায় যাবে? এমন ভাবনায় যখন দিশেহারা
তখন হঠাৎ রিয়ার কথা মনে আসে, রিয়া ফোন নম্বার দিয়েছিল।
বলেছিল যেকোনো প্রয়োজনে যেন ফোন দেয়।
ইতোমধ্যে বেশ লোক সমাগাম হয়েছে মাঠে। ফাঁকা বেঞ্চগুলো
খালি নেই। প্রেমিক-প্রেমিকা আর বিকেলে হাঁটতে আসা মানুষেরা
দখলে নিয়েছে। মাঠে কিশোর-যুবকদের বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন
দল ফুটবল খেলছে।
মাহফুজ রিয়াকে ফোন করে। আধাঘন্টার মধ্যেই রিয়া আসবে
জানায়। সূর্য ডোবে। বেঞ্চিতেই বসে থাকে মাহফুজ। খেলার
মাঠ শুন্য হয়ে পড়ে। বেঞ্চগুলো ফাঁকা হচ্ছে।
সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মশার উৎপাত বেড়ে যায়। মশা
খুবই বিরক্তিকর এবং ক্ষতিকার প্রাণী মনে হয় মাহফুজের।
সবার বেলায় হয়তো তা হয় না। কিন্তু মাহফুজের শরীরের যে
জায়গাটিতে মশা হুল ফোটায় সে জায়গাটা ফুলে যায়। দীর্ঘ সময়
ধরে চুলকাতে থাকে।
স্কুটি নিয়ে রিয়া সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে মাস্ক মাথায়
হেলমেট। স্কুটি একপাশে রেখে মাহফুজের কাছে আসে। মুখের
মাস্ক খোলে। তারপরও সন্দেহ থেকে যায় মাহফুজের। হোটেলে
রাতের আবছা আলোয় যেটকু দেখেছিল তাতে রিয়ার চেহারা
সঠিক মনে নেই। রিয়া হাত বাড়িয়ে বলেÑ আমি রিয়া। ও।
দাঁড়ায় মাহফুজ। হ্যান্ডশেক করে। বসতে বলে রিয়াকে। রিয়া
বসে না। বলে চলো।
কোথায়?
কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।
আপত্তি করে না মাহাফুজ। রিয়ার স্কুটির পেছনে উঠে পড়ে।
অতিরিক্ত হেলমেট মাথায় পড়ে নেয়। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ।
কলকাতার রাস্তায় স্কুটি চলছে। রিয়া দু’একটি কথা বলে। কিন্তু
প্রচন্ড বাতাসের বেগ রিয়ার কথা গুলো মাহফুজের কানে ঢুকতে
না দিয়ে গন্তব্যহীন অনন্তে ছুটে যায়। যেতে যেতে পূনরায় প্রকৃতির
কথা মনে হয় মাহফুজের। প্রকৃতি কি এমনটিই লিখেছিল আমার
জন্য? প্রাণীর জীবিকার একটি ব্যবস্থা করেই রাখে প্রকৃতি।
একটি রেস্টুরেন্টের সামনে স্কুটি থামায় রিয়া। কলেজ স্ট্রিট।
স্কুটি লক করে হেলমেট হাতে নিয়েই রেস্টুরেন্টে ঢোকে।
কর্নারের একটি টেবিল নিয়ে মুখোমুখি বসে দু’জন। ঢোকার
পরেই দু’জনার জন্য লুচি আর আলুরদম অর্ডার করে রিয়া।
রিয়াকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। জিন্সের প্যান্টের সাথে কুর্তা।
মাঝারি চুল রাবার ব্যান্ডে বাঁধা।
আমি জানতাম তুমি ফোন করবে। তবে এতো তাড়াতাড়ি আশা
করিনিÑ বলল রিয়া।
মাহফুজ অবাক হয়ে রিয়াকে দেখছে। বিমর্ষ চেহারা, একরাশ
হতাশা।
আচ্ছা তোমাকে এতোটা আপসেট দেখাচ্ছে কেন? পাসপোর্ট
এখন অবধি ফিরে পাওনি সেটা বুঝতে পারছি। অন্য কোন
সমস্যা?
মা হাসপাতালেÑমাহফুজ আর বেশি কিছু বলতে পারেনা। মাথা
নিচু করে চোখে জল মোছে। রেস্টুরেন্টের কিশোর ওয়েটার
টেবিলে লুচি আর আলুরদম এনে রাখে।
কর্তব্যবিমূঢ় রিয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলেÑনাও
লুচি। ঠান্ডা হয়ে যাবে।
চোখের জল মোছে মাহফুজ। দুপুরে খাওয়া হয়নি। পেটে প্রচন্ড
খিদে। তারপরও খেতে ইচ্ছে করে না। কেমন যেন অর্থহীন
চেয়ে থাকে।
খাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
রিয়ার ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সে।
খেতে খেতে আদ্যোপান্ত খুলে বলে রিয়াকে। ভেবোনা। পাসর্পোট
ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তোমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে
দিচ্ছি। তুমি শুধু মার জন্য প্রর্থনা করÑ বলল রিয়া।
শুকিয়ে কাঠ হতে যাওয়া মাহফুজের বুকটা রিয়ার কথায় যেন
প্রাণ ফিরে পেল।
রেস্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে মাহফুজকে নিয়ে মির্জা গালিব স্ট্রিটে
ফিরে এলো রিয়া। পরিচিত এক হোটেলের সামনে থামল।
মাহফুজকে নিয়ে রিসেপশনে গেল। বলল বিস্তারিত। রিয়ার
কথায় সেই হোটেল কর্তৃপক্ষ রুম দিতে রাজি। কিন্তু বাঁধ সাধল
পাসর্পোট। পাসর্পোট ছাড়া রুম দিলে পুলিশ চেকিং এ তারা
বিপদে পড়বে। তাছাড়া ভারতে প্রবেশের পাসর্পোট সিল,
তারিখ ভিসার কপিও তাদের চাই।
কাছাকাছি বেশ কয়েকটি হোটেলে চেষ্ঠা করল রিয়া। কাজ হলো
না। পাসর্পোট ছাড়া কেউ রুম দিতে রাজি হলো না।
দম নিয়ে বেরিয়ে এলো দু’জন। অসহায় মাহফুজের চোখে
হতাশা ঘনীভূত।
স্কুটিতে হেলমেট রেখে কোথায় যেন ফোন করল রিয়া। তারপর
বললÑ চলো।
রিয়ার পেছনে স্কুটিতে উঠে বসল মাহফুজ। স্কুটি ছুটে চলছে।
যেতে যেতে পার্ক স্ট্রিটের সেই কুকুরের কথা মনে হলো তার।
একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটে চলা।
রিয়ার স্কুটি হাবড়া ব্রিজ পেরিয়ে কেরি রোডে টিনশেড একটি
বাড়ির সামনে এসে থামল। ফোন করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে
একজন যুবক এসে রিয়ার সাথে কথা বলল।
রিয়া পরিচয় করিয়ে দিল। যুবকটি অজয়। প্রেসিডেন্সিতে
পড়ছে। রিয়া মাহফুজের বিষয়ে সবটা বলল অজয়কে। অজয়
খুব আফসোস করল।
কাল দেখা হচ্ছেÑ একথা বলে বিদায় নিল রিয়া। অজয়ের পিছু
নিল মাহফুজ।
টিনশেড বাড়িটির এক সারিতে বেশ ক’টি ঘর, একটি ঘরের
ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল অজয়। সাথে মাহফুজ।
ছোট্ট একটি ঘর। তিনটি চকি পাতা। আলাদা তিনটি বিছানা।
চেয়ার-টেবিল। একটি চকি দেখিয়ে অজয় বললÑ ওখানটায়
তুমি থাকো। ফ্রেশ হয়ে নাও।
মাহফুজ বুঝতে পারে বিছানাটি অন্যকারো। হয়তো ছুটিতে
বাড়ি গেছে। নিজ থেকে আর জানতে চাইলো না।
পাঁচ দিন পেরিয়ে গেল অজয়ের ঘরে। মেসের কেন্টিনে খাওয়া
দাওয়া চলছে। রিয়া এসে খোঁজ নিচ্ছে। ঘুরতে নিচ্ছে।
বাংলাদেশে মায়া ও লুনার সাথে কথা হচ্ছে অনেক সময় নিয়ে।
মায়ের অবস্থার কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। নিজের দূরাবস্থার
কথাও বাংলাদেশে জানাচ্ছে না। লুনা বারবার মিনতি করছে
তুমি দিল্লি আয়ারল্যান্ড এম্বেসিকে ইমেইল করে জানিয়ে দাও
তোমার ভিসা চাই না। পাসর্পোট ফেরত চাই।
অনেক দিন তো হয়ে গেল। দেখি না আর ক’টা দিন। লুনাকে
দমাতে চায় মাহফুজ। কিন্তু বিদেশে অসহায় হয়ে নিজেরই দম আটকে
আসে। ইতোমধ্যে রিয়াও লুনার মতো পাসর্পোট ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলে
ইমেইল করেতে বলে। মাহফুজের সেই একি উত্তরÑদেখি আর ক’টা দিন।
আর ক’টা দিন সইল না সময়ের। আরও চারদিন পেরিয়ে রাত তিনটায়
লুনার ফোন এলো বাংলাদেশ থেকে Ñ মা আর নেই।
মাহফুজের সারা শরীর কাঁপছে, মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। ঘরের ভেতরটা
অন্ধকার, দরজা-জানালা বন্ধ। টিনশেড এবং দেয়ালের ভ্যান্টিলেশন দিয়ে
আসা মৃদু আলোতে ঘরটি আবছা আলোকময়, মা-গো….। চিৎকার দিয়ে
অজ্ঞান হয়ে পড়ে মাহফুজ। চিৎকার শুনে পড়ি-মরি জেগে ওঠে অজয়। সুইচ
অন করে ঘরে আলো দেয়। পাখাটি ঘুরছে।
মাহফুজের দেহের অর্ধেকটা বিছানায়। আর পা’দু’টি চকিতে ঝুলছে। হাতের
মুঠোয় মুঠোফোন। মুঠোফোনের ওপ্রান্ত থেকে হ্যালো হ্যালো কন্ঠ ভেসে
আসছে।
মাহফুজের ঝুলন্ত পা’দু’টি বিছানায় তুলে দিয়ে ডাকে অজয়।
কোনো সাড়া শব্দ নেই। অজয় বুঝতে পারে মাহফুজ জ্ঞান হারিয়েছে।
হাতের কাছের জলের বোতল নাকে-মুখে ছিটায়। কাজ হয় না। হাত থেকে
মুঠোফোন নিয়ে কানে তোলে।
হ্যালো। কে বলছেন? বললÑঅজয়।
ও প্রান্তে লুনা। বললÑ মাহফুজের মা আর নেই। আমরা হাসপাতাল থেকে
বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।
মাহফুজ জ্ঞান হারিয়েছে। আমরা ওকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করাছি।
বলল অজয়।
প্লিজ দাদা, ও প্রান্তে লুনার কান্নাজড়ানো কন্ঠ। বিয়াকে ফোন দেয় অজয়।
পাশের ঘরের দু’জনকে ডেকে মাহফুজকে হাসপাতালে নেয়। হাসপাতালে
ভর্তি নিয়েও বিপাকে পড়তে হয় অজয়দের। মাহফুজ বাংলাদেশের
নাগরিক। পাসর্পোট নেই। বিস্তারিত বললেও ভর্তি করে ঝামেলায় জড়াতে
চায় না হাসপাতাল, অজয়দের জোরাজুরি আর মানবিকতায় ভর্তি নেয়।
গভীর পর্যবেক্ষনে নিয়ে রাখতে হয় মাহফুজকে।
পরদিন সকালে রিয়া এসে হাজির। অজয়ও সহপাঠিরা সেই অবধি
হাসপাতালের করিডোরে। জ্ঞান ফেরেনি মাহফুজের।
এ কিসে জড়ালি? যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে আমরা সবাই ফেঁসে
যাব। হাসপাতাল কিন্তু আমাদের সবার নাম লিখে নিয়েছে। বলল অজয়।
রিয়া চুপচাপ।
দেশের হলে ভিন্ন কথা। কিছু একটা বের করে নিতাম। তো অন্য দেশের
উপকার করতে গিয়ে জেলের ঘানি টানোÑ অজয়ের আক্ষেপ।
ভয়া পাওয়ার কিছু নেই। আমি দেখছি সাহস যোগায় রিয়া। ব্যাগ থেকে
মুঠোফোন বের করে ফোন করে ফোনে কথা শেষ করে রিয়া বলেÑসুনন্দাকে
আসতে বলেছি। খবরের কাগজে চাকরি করে। ও ব্যাপারটি নিয়ে চমৎকার
একটি রিপোর্ট করলে সরকার-প্রশাসন সবার কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে
যাবে।
হুম। ঠিক বলেছিস। আচ্ছা রিয়া বলতো দেখিÑ বাংলাদেশ, একটা ছোট্ট
দেশ বলে ওদেশে বিশ্বের সব দেশের এম্বেসি নেই। এই যে কলকাতায় কি
সব দেশের এম্বেসি আছে? নেই। সব দিল্লিতে । ভি এফ এস এর মাধ্যমে
আমাদের আবেদন করতে হয়। বাংলাদেশেও তো ভি এফ এস আছে।
বাংলাদেশের নাগরিকরা ভি এফ এস এর মাধ্যমে অথবা এম্বেসি না থাকলে
ওসব দেশের কনস্যুল জেনারেল থাকতে পারেÑতাদের মাধ্যমে আবেদন
করতে পারে। তাহলে সাধারণ মানুষের এতোটা ভোগান্তি পোহাতে হয় না।
হুম। তুই ঠিকই বলেছিস। সুনন্দা আসলে তুই এসব কথা বলিস। ওর
রিপোর্ট লিখতে হেল্প হবে।
তাছাড়া এটাতো বাংলাদেশের জন্যও হানিকর। একটি দেশে ভ্রমণ করতে
তাদের বাধ্য হয়ে ভারতে আসতে হচ্ছে। ভারতে আসতেও ভিসা প্রক্রিয়ার
মাধ্যমে আসতে হয়। কতোটা ভোগান্তির তুমি একবার ভেবে দেখেছো?
বলল অজয়। তাই তো! তারা কেন বছরের পর বছর বিষয়টি নিয়ে ভাবছে
না কি জানি? বাংলাদেশের আরও একটি বিষয় নিয়ে আমি বেশ ক’বার
ভেবেছি। বলল অজয়।
কি?
বাংলাদেশের প্রচুর রোগী ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হাসপাতালে চিকিৎসা
নিতে আসে। এর মানে কি ঐ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব দুর্বল?
কি জানি! হয়তো দূর্বল। নতুবা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক অন্যকোনো
সমীকরণ থাকতে পারে।
বাদ দে ওসব। দেখা যাক, এবার সুনন্দার রিপোর্টে কোনো কাজ হয় কি না।
দু’দিন পর জ্ঞান ফিরল মাহফুজের। ওর মুঠোফোনটি রিয়ার কাছেই ছিল।
ইতোমধ্যে মায়া-লুনা বাবার করে ফোন করছে। কান্না করছে। মায়ার
পাসর্পোট নেই। লুনার পাসর্পোট আছে। ভারতে আসার ভিসা পেতে
দীর্ঘসূত্রিতা আছে। তারপরও সে মরিয়া হয়ে চেষ্ঠা করছে মাহফুজের পাশে
থাকার।
দৈনিক ‘কলকাতা সংবাদ ’ পত্রিকায় চমৎকার রিপোর্ট বেরিয়েছে সুনন্দার।
সংবাদটি আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দু’দেশে। কলকাতার বাংলাদেশ
হাই কমিশন হাসপাতালে মাহফুজের পাশে দাঁড়িয়েছে।
যেসব দেশের এম্বেসি বাংলাদেশে নেই সেসব দেশে যেতে বাংলাদেশ থেকে
কিভাবে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে উপায় বের করার কথা
বলেছে।
ইতোমধ্যে দশ দিন পেরিয়ে গেছে। মাহফুজ সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে তার
বা পা’টা ভালো কাজ করছে না। মাইনর স্ট্রোকে হয়তো ওর পা সøথ করে
দিয়েছে। মাহফুজের মুখে কোনো কথা নেই। ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকে। বেডের
পাশে রিয়া-অজয়। ওরা অনেক চেষ্ঠা করেছে কথা বলানোর । কিন্তু মাহফুজ
কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে। দু’পাশে গাল বেয়ে চোখের জল ঝরছে।
তাহলে কি মাহফুজের বাক বন্ধ হয়ে গেল? ভয় পেয়ে যায় রিয়া ও অজয়।
হঠাৎ অজয়কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে মাহফুজ। মাহফুজের কান্নায় দীর্ঘশ্বাস
ছাড়ে রিয়া। হায়রে স্বপ্ন!
হায়রে জীবন! মানুষ জীবনে কতো কিছু হতে চায়! কতো কিছু পেতে চায়!
সব কি আর পাওয়া হয়!
পরদিন মাহফুজের মুঠোফোনে আয়ারল্যান্ড এম্বেসি থেকে একটি র্বাতা
আসে। ফোনটি রিয়ার হাতেই ছিল। রিয়া দেখে এম্বেসি জানিয়েছে মাহফুজের
আয়ারল্যান্ডের ভিসা কনফার্ম হয়েছে। ভি এফ এস গ্লোবাল কলকাতা থেকে
পাসপোর্ট সংগ্রহের অসুরোধ জানায়।
সংবাদটি মাহফুজের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। বেডের পাশেই
বসা ছিল রিয়া রিয়ার হাত ধরে মুখে এক চিলতে হাসি টেনে বলেÑমায়ের
কাছে ফিরে যাওয়ার মতো আনন্দ এ পৃথিবীতে আর নেই।