বিছানায় ঢলে পড়া ঘুম নিয়ে নদীর মতো বয়ে চলে সুরভী।
কী চমৎকার উষ্ণ সৌরভময় তার প্রবাহ! আফিম-এ ঢাকা
পবর্তের পাশে, যখন আফিম ফুলে-ফুলে রঙিন, যখন কৃষেকরা
চাষ করে, যখন আফিম শুকায়, তখন তারাওতো নেশা করে।
তাদেরও তো নেশা হয়। হয় কী? সুরভীর ঘুমে কী সেই নেশাঘোর
ভর করে রয়েছে, আর তা মেখে রয়েছে পাশবালিশে, মাথার
কালো চুলে। নদী যেমন বেঁচে থাকে নদীরই ঢলনামা প্রবাহে,
শাখা-প্রশাখা বিস্তারের প্রয়োজনে কেবল নয়। সুরভীওতো বারবার
পাশ ফিরে ঘুমায়, ডানে-বায়ে পানির ঢল নামিয়ে, বয়ে চলে
লবণ-পর্বতের উপত্যকায়।
এখন এক নির্মল ঘন রুদ্দুর এসে খেলে যাক তার চোয়ালে, চুম্বনে। না,
ঘাম নয়। রৌদ্রের খেলায় লেগেছে বুঝি আফিমযুদ্ধ।
চিন ও ব্রিটেনের এই যুদ্ধে কী ঘটেছিল, তা লেখা আছে ইতিহাসে।
কিন্তু এখানে তো ঠিক সেই ইতিহাস নেই, তবে আছে ঘুম-জাগরণের
ঘোরলাগা গল্প। আফিমের নেশায় আসক্ত চিনা সেনাবাহিনীর পরাজয়ের
মতো ইলিয়াসওতো পরাজিত হয়। উৎসবের আনন্দে আফিম আর
চায়ের নেশা বয়ে চলে তার দেহে, একই প্রবাহে। যেভাবে ব্রিটিশরা
আফিম বিক্রির টাকায় চা কিনে খেয়েছিল, ঠিক সেইভাবে। সে কোনটা
কিনে খাবে? আফিম নাকি চা!
সুরভীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কোনো এক উৎসবের দিনে, দিন
তারিখ ঠিক মনে নেই। উৎসব মানে, পুজো-ইদ-বৈশাখ এইসব।
কোথাও বেড়াতে গেলেই বাঙালির প্রেমরোগ ওঠে, কেউ-কেউ সদ্য
যুবতীর প্রেমে পড়ে। দূরে কোথাও, পাহাড়ে-সমুদ্রে-মাঠে গেলে শরীরের
আশ্চর্য রক্ত বেয়ে-বেয়ে ওঠে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত। ইলিয়াস দেখেছিল সুরভী
বসে রয়েছে বৃক্ষরাজির অতলে, উদ্ভিদের সবুজের বুকের ভেতরে। না,
কোনো আড়াল নেই। উদ্ভিদে ও নারীতে। সদ্য-সদ্য ফুলের পাপড়ি
ঝরে ফুটেছে ফুল। তারপর কিছুপরে যখন মেয়েটি নিচু হয়ে নেমে, চলে
যেতে থাকে বনভূমির ঢালু রাস্তা বেয়ে, আনমনে, রুগ্ন-শুষ্ক-মøানমুখে,
তখন বনভোজন করতে আসা এক যুবকের মন দলছুট হয়ে হারিয়ে
যায়, সুরভীত লবণ পর্বতের উপত্যকায়। ‘মুলঙ্গী’রা যেমন সমুদ্রের জল
সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করতো বছরের পর বছর, ঠিক তেমনই
প্রকৃতিতে চলমান তীব্র শীত উপেক্ষা করে, নিজের দেহের কোথাও
লবণ উৎপাদনের উত্তাপ সে অনুভব করতে থাকে।
আমাদের মাথার ওপরে কী গভীর নীল আকাশ! বাস্তবে তা যেমন ঠিক
নীল নয়, ঠিক তেমনই দেহে লবণের উৎপাদন যখন চলছিল হাজার
হাজার টন, কিংবা চারপাশে নিস্তব্ধতা ছিল, তখন কেউ করতালি
বাজিয়ে দিয়ে গেল। সুরভী ইলিয়াসকে তখনও দেখেনি, শুনতে পায়নি
তার নিঃস্বাস-প্রশ্বাসের উত্থান-পতন।
এখন সোৎসাহে বিছানায় ঘুমন্ত সুরভীর মুখ দেখে ইলিয়াস। মুখই কী
দেহকোষের পরিবর্তনইে কী কেবল বয়স বাড়ে? কোষের
নিউক্লিয়াসের হরমোনের বৈষম্যে, প্রতিলিপি তৈরির অভাবে।
রেশনকার্ড নবায়নের মতো দেহ আর নবায়ন করে না নতুন কোষ।
তাতে কী? ঘরের বারান্দা থেকে বিকেল বেলা সুরভীর ঘরে ফেরাটা
যখন দেখে ইলিয়াস, তখন তাকে নিউক্লিয়াসের মতোই লাগে।
সে শুধু দেখে? মুখ? একটি মানুষীর মুখ? যেখানে লবণময় বনভূমিতে
খেলা করে বাতাসের আয়োডিন। খেলে কী?
এই একটা বালিশ বুকের কাছে চেপে ধরে ঘুমিয়ে আছে সুরভী;
শান্ত, স্নিগ্ধ এবং চিন্তামুক্ত। ঘুম ভাঙলেই হাজারটা চিন্তায় সেও কেঁপে
উঠবে, তীক্ষè এবং বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকবে মুখের দিকে,
তারপর শীত-বিকেলে হিম হয়ে থাকা মেঝেতে পা রেখে নেমে পড়বে
কাজেকর্মে। দুটো বাচ্চাকে সে পড়ায় সারাদিনে, ইলিয়াসের সাথে
সাথে সেওতো কাজ করে। এভাবে কাজ করতে-করতে হয়তো
অকালে বুড়িয়েও যাবে।
দেহকোষের পরিবর্তনইে কী কেবল বয়স বাড়ে? কোষের নিউক্লিয়াসের
হরমোনের বৈষম্যে, প্রতিলিপি তৈরির অভাবে। রেশনকার্ড নবায়নের
মতো দেহ আর নবায়ন করে না নতুন কোষ। তাতে কী? ঘরের
বারান্দা থেকে বিকেল বেলা সুরভীর ঘরে ফেরাটা যখন দেখে ইলিয়াস,
তখন তাকে নিউক্লিয়াসের মতোই লাগে। যেন এই নারীর চারপাশে
জমে আছে বাস-ট্রাক-রিক্সার বিষাক্ত প্রোটিনকণা, টক্সিন এবং কালো
ধোয়াঁর আলঝেইমার-পারকিনসন্স। রাস্তার পরিপাক ক্ষমতা হ্রাস
পাওয়ায় ভাঙা রাস্তায় জমেছে চিনি-শর্করার ডায়বেটিস, ইনসুলিন
দেওয়ার লোক নেই। এইসব রোগাক্রান্ত ভূমিতে পা ঠেলতে-ঠেলতে
বাড়ির দিকে যখন এগিয়ে আসে, ডানদিকে পড়ে ফুচকার দোকান
আর বামদিকে ফুটপাত, তবুও রাস্তার মাঝখান দিয়েই হেঁটে-হেঁটে সে
আসতে থাকে। খুব সাবধানে।
ডান পা আর বাম পা, সাবধানে ফেলতে-ফেলতে, মাথা নুয়ে রক্তবাহী
শিরার মতো রাস্তা-ফুটপাত ঘেরা জনপদ বেয়ে-বেয়ে। ঘরে ফিরলে
তার ঈষৎ লালচে মুখের ঘামে বিরক্তি আর চিন্তার দাগ লেগেই থাকে।
রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে উঠতে গিয়েও হয়তো দুইবার ভাবে সুরভী।
পা ফেলবে কী ফেলবে না? এতো দ্বিধা কীসের সুরভী? যে জীবন
বেছে নেওয়া হয়ে গেছে, সে জীবন নিয়ে দ্বিধা কীসের?
এইতো সেদিনের কথা, ঝুঁকে কিছু একটা তুলতে গিয়ে কাঁধ
থেকে শাড়ির আঁচল পড়ে গিয়ে, চাপা খায় তার নিজের পায়েরই
সরু স্ট্রাপের চপ্পলের নিচে, তখনও দ্বিধা করেছিল সে। এইসব
দূর থেকে দেখছিল ইলিয়াস। পরে ঘটনাটা জানাতেই সুরভী
বলে উঠেছিল, ‘এগিয়ে গেলেই তো পারতে। দেখছিলে কেন
বসে-বসে?’ তবে বিস্ময় আর বিরক্তি চাপা দিয়ে হাসিমুখেই
কথাগুলো বলেছিল। তাকিয়ে থেকেছিল চোখের দিকে, দুর্ভাগ্যে
মাখামাখি কাদামাটিতে ভেসে যেতে-যেতে, কিংবা চোরাবালিতে
ডুবে যেতে-যেতে দুজনই একটু খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। যতই
নড়চড়া করছে, ততই ডেবে যাচ্ছে মাটি, চোরাবালি টেনে নিচ্ছে
অতল গহ্বরে, ব্ল্যাক হোলের ভেতরে, যেখান থেকে ফিরে আসা
যায় কি-না জানা নেই।
হাসতে জানে সুরভী। কী গভীর থুতনির খাঁজে আভিজাত্য ফুটে
থাকে। ঘুম ভাঙবার পরে চোখে আলো লাগছে বলে চোখ ঢেকে
মুখ তুলে ধরে সুরভী। বলে, ‘প্যাকেটটা কই?’
‘কোন প্যাকেট? কোনটা? ওই-যে সেদিন পড়ানো
শেষে ঘরে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিলে, সেটা।’ প্রশ্ন
করে ইলিয়াস।
‘হুম। দেখেছ, প্যাকেটে কী আছে?’
‘কই! নাতো।’
‘ঠিক আছে।’ কথাটা বলতে বলতে সুরভী এগিয়ে যায় টেবিলের
দিকে, যেখানে কাগজের একটা প্যাকেট ভাঁজ করা রয়েছে।
যেটা আবার বেশ যত্ন করে স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো এবং খুলতে
গেলেও বেশ ঝক্কি পোহাতে হবে।
তাতে কী? এই কাগজের প্যাকেট খুলে কী বের করবে সুরভী,
তাতো ইলিয়াস জানে না। যদিও টেবিলের ওপর প্যাকেটটা
দেখে, তার মনে যে কোনো প্রকার আগ্রহের জš§ নেয়নি তা কিন্তু
নয়। আগ্রহ জšে§ছিল। শহুরে মানুষের নানারকম গোপন গল্পের
মতো নিশ্চয় একটা গল্প সেঁধিয়ে গিয়েছিল প্যাকেটের পেটের
ভিতরে। কল্পনায়, ছায়াছবিতে, জলছবির টানে। ইলিয়াসের বাবা
ওইরকম প্যাকেটে মুড়িয়ে জিলিপি আনতেন বাজার থেকে। তা
অবশ্য স্কচটেপে মোড়ানো থাকতো না, কারণ তখনো স্কচটেপের
চলাচল শুরু হয়নি। কাগজের প্যাকেটের মুখটা এমনি মোড়ানো
থাকতো, আর প্যাকেটের ওপর ভেসে থাকত গরম জিলিপির
ঘাম, চিনির গুড়া, সাদাটে দাগ। প্রিয় গল্পের মতো একটা
একটা করে জিলিপি খেতে-খেতে হাট-বাজারের গরম ভীড়টা
সেধিঁয়ে যেতো বুকের ভিতরে। তাছাড়া যে লোকটা এই জিলিপি
ভাজতো তাকেও তো বেশ চিনতো ইলিয়াস। সেই লোকটার
নাম সুজন। জিলিপির জন্য মাখানো আটা-ময়দার খামিরে, গরম
তেলের ওপর ভেসে থাকা প্যাঁচে-প্যাঁচে কত গল্পই-না খোদাই
হয়ে আছে। সুজনের হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে যখন জিলিপির
খামিরের ক্ষীর বের হয়ে আসতো, যখন এক কড়াই তেলের
ঢেউয়ের ভেতরে নির্জন জিলিপিগুলো ভাসতো আর ডুবতো,
তখন পাশের কড়াইয়ে অপেক্ষমাণ চিনির সিরায় মাছি পড়ার
ভয় থাকতো। একটা গামছা দিয়ে সেই চিনির সিরা ঢেকে রেখে
গরম তেলের ভেতরে বাদামি-লাল করে ভেজে-ভেজে তুলতো
সুজন। জিলিপির ভাঁজ করা প্যাকেট খেলার সাথে-সাথেই
জিলিপি বানানোর পুরো দৃশ্যটা ভেসে উঠতো চোখের সামনে।
সেইরকমই কিছু একটা হয়তো রয়েছে সুরভীর প্যাকেটের
ভিতরে। এমনই ভেবেছিল ইলিয়াস। না, তার বদলে বের হয়ে
হলো একটা কাচের ভাঙা ফুলদানি। চার থেকে পাঁচ টুকরো
হয়ে ভাঙা ফুলদানিটাই অনেক যত্ন করে বেঁধে রেখেছে সুরভী।
কাগজে, স্কচটেপে। কেন?
‘তোমার কাছে সুপার-গ্লু আছে?’ ইলিয়াসকে চমকে দিয়ে প্রশ্ন
করে সুরভী।
‘কই-না তো।’ চমকে গিয়ে থতমত খায় ইলিয়াস। প্রয়োজন না
পড়লে কে আবার সুপার-গ্লু কেনে? ইলিয়াসের ভেতরে বিরক্তি
চমকে উঠে সুরভীর মুখের দিকে তাকায় ইলিয়াস। দেখে, সেখানে
এক বিষণ্ন-বিপন্ন নদী বয়ে চলেছে অন্তহীন পথে। সেই নদীতে সাঁতার
কেটে পৌঁছে যেতে হবে তীরে। কালো, গভীর, ক্ষীরজমা গহীন সেই
নদীর একপাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়াটা ঠিকমত দেখা যায় না।
তৈরি হয়। তবুও বিরক্তি ঢেকে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘কিনে আনবো
এখনই, কী বলো?’ তারপর একটু থেমে ফুলদানির ভাঙা টুকরোগুলো
নাড়তে-নাড়তে বলে, ‘তুমি কী এগুলো জোড়া লাগাতে চাইছো? কাচের
ফুলদানি। জানি না, জোড়া লাগবে কি-না।’
‘আমার কিন্তু জোড়া লাগাতেই হবে। নইলে এ-মাসের বেতন পাবো না।’
‘বলো কী? একটা সামান্য ফুলদানি!’ চমকে উঠে সুরভীর মুখের দিকে
তাকায় ইলিয়াস। দেখে, সেখানে এক বিষণ্ন-বিপন্ন নদী বয়ে চলেছে
অন্তহীন পথে। সেই নদীতে সাঁতার কেটে পৌঁছে যেতে হবে তীরে।
কালো, গভীর, ক্ষীরজমা গহীন সেই নদীর একপাড়ে দাঁড়ালে অন্য
পাড়াটা ঠিকমত দেখা যায় না। নতুন সাঁতার শেখার মতো পানি খেতে
খেতে শিখে নিতে হবে সাঁতার। এক-একবার আঘাতে, পানির বুকটা
যেন তোলপাড় করে ওঠে প্রত্যাখ্যানের ভারে, বিরহে। তারপর আরেকটা
আঘাত। হাতের আঘাতে, পায়ের আঘাতে পৌঁছে যেতে হবে সম্মুখের
পথ বেয়ে। বুকের ভেতরের ব্যক্তিগত ফুলদানির ফুলে সুরভীর মিষ্টি সুবাস
পেতে চাইলে এই নদী পেরুতেই হবে। প্রতিদিন পেরুতে-পেরুতে বেলা
বয়ে যায়, তবুও ক্রমে পথ দীর্ঘ হয়ে আসে। পাঁজরের হাড়ে গেঁথে থাকে
পিপাসার কার্তুজ।
সুরভীর প্রিয় গল্পের ভেতরে একটা গল্পÑ নদী পারাপারের গল্প। শৈশবের
এক ক্ষীণস্রোতা নদীর ঢেউয়ের গল্প। পায়ে-পয়ে সেই নদী পেরুবার
গল্প। বরষায় যখন হাঁটুসমান পানি হতো সেই নদীর, তখন দলবেঁধে
গাঁয়ে ছেলে-মেয়েরা গোসল করতে যেতো। সুরভীও গোসল করতে
নেমে, সাবানের ফেনার বুদবুদে সেনালি-লাল আলোর আর রঙধনুর
খেলা দেখতো। সেই ফেনা হাতের তালুতে কিছুক্ষণ ভেসে থেকে পানিতে
পড়ামাত্র ভেঙে যেতো টুপ করে। কিংবা সামান্য ফুঁয়েই ফুলে উঠতো,
পাখা মেলতো বিশাল গোলকের মতো। আবার হঠাৎ সেই
উš§ত্ত বিশাল বুদবুদ ঘোলাটে পানিসুদ্ধু টুপ করে ফেটে পড়তো
চতুর্দিকে। সামান্য পানির বেলুন ফেটে পড়ার অসামান্য আনন্দ
নিয়ে ঝরে পড়তো টুপটাপ। সামান্য ফুঁয়েই যা ভেঙে যায়, ভেসে
যায়, তা নিয়েই খেলা করতে মানুষের কতই না আনন্দ। এতো
সুরভীর ব্যক্তিগত আনন্দের গল্প, যা লেখা হয়েছিল বহু বছর
আগে। আজ কী তবে তার দুঃখের গল্পটি লেখা হবে। ব্যক্তিগত
দুঃখের গল্প। যেই গল্পের শব্দমালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা
কাচের টুকরোর দর্পণে, পরতে-পরতে।
এইভাবে একসময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলার আলো এসে
গলে-গলে পড়বে, তখনও একটু অলস সময়ও কী দুজনার
নিজেদের হবে না। তৃতীয়জন আসবার খবরতো এইতো
সেদিনই জানার সুযোগ হলো। ডাক্তারের কাছ থেকে শুনে শুধু
নয়, প্রেগন্যান্সি কিটস দিয়ে পরীক্ষা করেও মুখে হাসি ফুটেছিল।
সেই হাসি গড়িয়ে গিয়ে পড়েছিল শেষ বিকেলের আলোয়। অথচ
দেখোতো, সেইসব মধুস্মৃতি বাদ দিয়ে দুজনে পড়ে রয়েছে
একটি কাচের ফুলদানির দিকে। তাও আবার ভাঙা। ইলিয়াস
পরম যত্নে সুরভীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি চাকরিটা
ছেড়ে দাও। মানে…পড়ানোটা। একটা ফুলদানির জন্য যদি
বেতন কাটার ভয় দেখায়, তবে পড়ানোই উচিত নয়।’
সুরভী তাকিয়ে থাকে ইলিয়াসের মুখের দিকে। কী একটা কথা
বলতে গিয়েও বলতে পারে না। একটু থেমে দম নিয়ে বলে,
‘আমি তো দাম দিতে চেয়েছি।’
সুরভীর অসহায় মুখের দিকে চেয়ে ইলিয়াস প্রশ্ন করে, ‘তারপর,
তারপর ওরা কী বলল?’
‘এটার নাকি কোনো দাম নেই। মানে, কোটি টাকা দিলেও নাকি
হবে না। কী যে মহা ক্ষতি আমি করেছি তাদের। খুব প্রিয় একটা
স্মৃতি ভেঙে ফেলেছি।’
ইলিয়াস খুব বিস্ময় নিয়ে দেখে ফুলদানিটা, একটা ছোট্ট শিশু
একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এমনভাবে ভেঙেছে
যে, শিশুটা একদিকে আর ফুলগুলো আরেক দিকে সরে গেছে।
বড়ো বেদনা নিয়ে শিশুটা তাকিয়ে রয়েছে ফুলগুলোর দিকে,
আর তাতে কাচের গুড়ো লেগে আছে চোখের পানির মতো।
একখণ্ড কাচ-তো বালির সিলিকার গলিত অবস্থা থেকে হঠাৎ
শীতলকরণের মাধ্যমে করে গড়ে তোলা স্ফটিক, তাইতো কখনো
কখনো সেটা ছুরির ফলার মতো ধারালো হয়ে উঠতে পারে। এ
কারণে প্রস্তরযুগে কাচ ছিল ধারালো অস্ত্রের উৎস, তাইতো কাচের
ফুলদানিটাও অস্ত্রের মতো বুকের মধ্যে বিঁধে যাচ্ছে। আগুনের
উত্তাপে, বালি-কাদার স্তরীভূত মণ্ডে, বাষ্পীভবনে, ছেনির শেপে,
সুদৃশ্য ফুলদানি গড়ে উঠতে পারে কারিগরের হাতে; তবে তাতো
মানুষের চোখের পানির চেয়ে দামি কিছু নয়। এক পলকের ভুলে,
হাত ফসকে পড়ে যাওয়া ফুলদানির জন্য কাউকে অপরাধী করা
ঠিক নয়। এখন আঠালো সুপার-গ্লু ঢেলে টুকরো-টুকরো হয়ে
ভেঙে যাওয়া ফুলদানির শিশুমুর্তি আর গোলাপ ফুলগুলো এক
জায়গায় করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ইলিয়াস। সুরভীও
ঘাড়-মাথা বাড়িয়ে ইলিয়াসের ঘাড়ের ওপর দিয়ে গমগমে শ্বাস
ফেলতে-ফেলতে কাচের টুকরোগুলোর জোড়া লাগনো দেখতে
থাকে। সুপার-গ্ল ু পাওয়া গেলো ইলিয়াসের টেবিলেই, জানালার
পাশের সেই পড়ার টেবিলে, যেখানে পড়তে বসলে পড়াটা আর
হয়ে ওঠে না; বাইরের পৃথিবীটা দেখতে-দেখতেই কেটে যায়
সারাটা দিন। অল্প সুপার-গ্লু দিয়েই টুকরোগুলো জোরে চেপে
ধরে; কিন্তু ডানদিকে চেপে ধরলে বামদিকে টুকরোগুলো ঠেলে
স্থানচ্যুত হয়ে যায়, আর বামদিকে চাপ দিলে কাচের টুকরোটা
যায় সরে ডানদিকে। তারপর টুকরোগুলো জোড়া না লেগেই
ছিটকে বেরিয়ে যায় হাত থেকে, দূরে। মেঝেতে পড়ে আরও
টুকরো হয়ে ভেঙে-ভেঙে যায়, তাতে বোকার মতো সুরভীর
মুখের দিকে তাকায় ইলিয়াস।
সুরভীও চোখের জল মুছে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে
যেতে বলে, ‘যাই, তোমার জন্য চা করে আনি।’ যেন কিছুই
হয়নি। কিছুই ঘটেনি। সুরভী রান্নাঘরে চলে যাবার পর, ইলিয়াস
বোকার মতো কাচের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর
বিছানা থেকে নেমে দেখেÑরান্নাঘরের বাতিটা নেভানো। কেউ নেই
সেখানে। ড্রয়িংরুমে আধো অন্ধকারে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে
সুরভী। এবার হাওয়ার ডাকপিয়ন বুঝি তাকে বলে দেয় ইলিয়াস এসেছে
ড্রয়িংরুমে, তাইতো হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে সুরভী। ইলিয়াস ডেকে
ওঠে, ‘সুরভী সুরভী।’ কিন্তু সুরভী কেঁদে চলে অবিরল। কাঁদতে-কাঁদতে
বলে, ‘আমাদের বাবুটার জন্য ফুলদানিটা গিফট করেছিল ওরা। সেটা
আজ এইভাবে ভেঙে গেলো। আমাদের বাবুটার যদি কিছু হয়।’
কথাটা বলে আবার কাঁদতে থাকে সুরভী। এইবার ইলিয়াস বোঝে
ফুলদানির রহস্য, বেতন কাটাকাটির ঘটনা নেই এখানে। যেই বাসায়
সুরভী পড়ায়, সেই বাসার লোকেরাই গিফট করেছে ফুলদানিটা।
অনাগত শিশুর জন্য উপহার হিসেবে পাওয়া ফুলদানিটা ভেঙে ফেলে,
নিজেকেই ক্ষমা করতে পারছিল না সুরভী। তাইতো নানারকম গল্প
তৈরি করে নিজেকে প্রবোধ দিতে চাইছিল। যত্তোসব কুসংস্কার!
ইলিয়াস সুরভীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘ঘরে চলো সুরভী।
দেখো, আবার পা যেন না কাটে।’ ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে আকাশে।
সেই আলোয় সুরভী দেখে এক টুকর কাচের গুড়োও পড়ে নেই শোবার
ঘরে। ইলিয়াস অনেক যত্ন করে মেঝেটা পরিষ্কার করেছে। ঝেড়েছে,
মুছেছে। ফুলদানির ভাঙা কাচের গুড়োগুলো রেখেছে অ্যাকুরিয়ামের
জলের মাঝে, তাতে ঠিকরে পড়ছে জোছনার আলো। সেই আলোয়
খেলা করছে একটা সোনালি গোল্ডফিশ।