সংস্কৃতমনা

                          অমল সাহা

songkritomona

শরিফুল যখন নবনীর সাথে প্রেম করেছিল বা প্রেমে পড়েছিল
তখন নবনীর বাবার সাথে শরিফুলের পরিচয় হয় নাই।
এটা কোন ব্যাপার না। বরং এটাই স্বাভাবিক। মেয়ের সাথে প্রেম
করতে গেলে মেয়ের বাবার সাথে পরিচয় থাকতে হবে এমন কোন
বাধ্যবাধকতা নাই। কিন্তু প্রেমে পড়ার পর মানে সম্পর্কটা একটা
টান টান অবস্থায় যাওয়ার পর মেয়ের বাপদের বাগড়া দেয়াটাই
প্রচলিত প্রথা। পাত্র কী করে, পাত্রের চৌদ্দগুষ্ঠির পরিচয়, পাত্রের
ভূত ভবিষ্যৎ, স্বভাব চরিত্র মানে কোন প্রকার আলুর দোষ আছে
কিনা সবই মেয়ের বাপদের জানতে ইচ্ছে করে।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু নবনীর বাপের ব্যাপারটা একদমই অন্য
রকমের। শরিফুল সেদিন দাদীর স্ট্রোকের কথা বলে বসের কাছ
থেকে ছুটি নিয়ে নবনীর সাথে একটা পার্কে দেখা করে। অফিস
থেকে অফিস টাইমে বের হতে গেলে সে কোন বৃদ্ধ আত্মীয়
বা আত্মীয়াদের স্ট্রোকের কথা বলে অফিস থেকে বের হয়।
জোয়ান কোন আত্মীয়ের স্ট্রোকের কথা বলতে বিবেকে বাধে।
বস উদ্বিগ্ন হয়ে সেদিন বলেছিলেন, শরীফ সাহেব আপনাদের
বংশে স্ট্রোকের আধিক্য দেখছি। শরীফ কোন রকমে জবাব
দিয়োছল, জ্বী।
আজও দাদীর কথা বলে এসেছে। যাইহোক, শরিফুলের মন
বিশেষ ভাল না। কারণটা নবনী আগেই বলেছিল। একথা
সেকথা বলার পর ওদের মধ্যে আসল কথাবার্তা শুরু হয়। যে
জন্য আজ নবনী জরুরীভাবে শরিফুলকে ডেকে এনেছে।
Ñদেখো নবনী তোমার বাবা যাই বলুক তোমাকে আমি
ভালবাসি।
সেটা কে না জানে? আমার বাবাও জানে।
তো জানলে উনি বাগরা দিচ্ছেন কেন ?
বাগরা দিলো কোথায় ? ওনিও এটাও জানে শুধু তুমি না
পাড়ার অনেক বড় ভাইরাও আমাকে ভালবাসে।
এসব কি বলছো! আমার ভালবাসা হল খাঁটি বাকীগুলি
ভেজাল।
সেটা আমি জানি না ?
তা হলে ?
আচ্ছা তুমি কি চাও আমি বাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসি
খালি হাত পায়ে ? তুমিতো জানো আমি বাবার একমাত্র মেয়ে
বাবার সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি।
সম্পত্তির দরকার নেই-তুমি চলে আসো।
দেখো আমি বাবার কথার অবাধ্য হতে পারবো না। বাবা
অনেক অনেক দুঃখ পাবেন।
তোমার বাবা কী চায় ? ছেলে হিসাবে আমি খারাপ ?

বাবার একটা ছোট্ট চাওয়া।
কী ?
বাবা বলে দিয়েছেন, তার মেয়ের জামাই হবে ভদ্র মার্জিত
এবং সংস্কৃতমনা।
আমি কি যথেষ্ট ভদ্র এবং মার্জিত নই ?
কিন্তু সংস্কৃতমনা ?
মানে কী হলে উনি আমাকে সংস্কৃতমনা বলে মনে করবেন ?
সেটা তুমি নিজেই ঠিক করো।
দুজন গোমড়া মুখে অনেকক্ষণ বসে থাকে। শরিফুল মনে মনে
হবু শ্বশুরকে বরাহনন্দন বলে ভূষিত করে। এবং দাদা শ্বশুরকে
এধরনের একটা কুপুত্র, যে নাকি খামাখা মেয়ের জামাইয়ের
চরিত্রের সাথে এমন একটা মৌলিক বিষয় চাপিয়ে দিতে চায় যা
অসম্ভব, এধরনের একটা কুসন্তান জš§ দিয়ে মানুষের ভোগান্তি
বাড়াতে চাইছে সে জন্য শরিফুল দাদা শ্বশুরকেও নানাবিধ
গালির বাণে জর্জরিত করতে থাকে। নবনী একবার জিজ্ঞেস
করে, কী বিড়বিড় করছো?
শরিফুল চমকে উঠে। আবার শুনে ফেললোনাতো! শরিফুল
বলে ওঠে, না না ভাবছি তোমার বাবা কি সুন্দর একটা জিনিস
চেয়েছেন আমার কাছে। ধন নয় মান নয় . . . .এতটুকু চাওয়া।
ঠিকই বলেছ। নবনী বাপের দিকে টানে। শরিফুলের মেজাজ
খারাপ হয় নবনীর বাপের দিকে ঝোল টানা দেখে। সে অনেকটা
ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, চলো উঠি।
রাগ করলে নাকি?
না না রাগ করবো কেন? রাগ আমার বাবারও নাই।
নবনী শরিফুলের মুখ দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করে শরিফুল
কি সরলভাবে বলেছে নাকি অন্তরে গরল নিয়ে কথাটা বলেছে।
নবনী মন খারাপ করে বলে, মনে হয় তুমি রাগ করেছ।
আমাদের নিরাগ বংশ। রাগ নাই। আমাদের হ’ল গিয়ে
অনুরাগ বংশ।
সেটা আবার কেমন কথা হ’ল?

নবনী এবার পুরাপুরি আউলা হয়ে যায়।
২.
নবনীর বাবা মহিবুল্লা চৌধরী মাত্র গত বছর সরকারী চাকরি
থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনি প্রাক্তন সাহিত্য চর্চাকারী। চাকরি
করার সময় যা ছাইমাটি লিখতেন তাই অধঃস্তনদের দ্বারা অতি
উচ্চ প্রশংসা লাভ করাতে নিজেকে মহাবোদ্ধা বলে সাব্যস্ত
করেছিলেন। যেমনটা অনেক গর্ধভই করে থাকে। নিজের
পয়সায় একবার উপন্যাস ছাপিয়ে অফিসে বিলিও করেছিলেন।
সেসব অনেক আগের কথা। এখন তিনি শুধু বাড়িভাড়া এবং
পেনশন উপভোগ করেন। এবং মেয়ের জন্য সংস্কৃতমনা জামাই
খোঁজেন। বিষয়টা পাড়ার সবাই জেনে গেছে। তাই দু’একজন
হবু পাত্ররা সংস্কৃতমনা হওয়ারও চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে
অন্যতম একজন হ’ল পান্না। সে পড়াশোনায় ভাল করতে না
পেরে ব্যবসায় ভাল করায় মন দিয়েছে। সে বর্তমানে বড়ভাইদের
পিছনে ঘুরে কনট্রাক্টরী ধরার চেষ্টা করছে। এ হেন পান্না সকাল
বেলায়ই দুইটা পেঁপে হাতে নিয়ে মহিবুল্লার বাড়ি এসে হাজির।
মহিবুল্লা চৌধুরী আরাম কেদারায় বসে বই পড়ছিলেন।
কলিংবেল শুনে মহিবুল্লা উঠে গিয়ে দরজা খোলেন। পান্না হৃদয়
বিগলিতভাবে আস্ছালামুলাইকুম বলে। মহিবুল্লা খুবই খুশি হন।
মহিবুল্লা বলে, বসো।
পান্না বিপরীত দিকের সোফায় বসে। ইতিউতি তাকায়।
মহিবুল্লা মুচকি হেসে বলে, আমি জানি আমাকে ভেট দেয়ার
জন্য পেঁপে এনেছ। আমি এও জানি তোমার আসল উদ্দেশ্য
বাবাজীবন এটা নয় -অন্য কিছু। নবনীর সাক্ষাৎ পাওয়া। তাইনা?
পান্না হা হা করে ওঠে, না না চাচা মানে পেঁপে হল ভিটামিনধারী
ফল। আপনার মত বুইড়া মানুষদের জন্য পেঁপেটা খুব ভাল।
কোষ্ঠ কাঠিন্য সারায়।
আমার কোষ্ঠ কাঠিন্য আছে তোমাকে সেটা কে বললো?
ইয়ে মানে, এই বয়সে কোষ্ঠ কাঠিন্য থাকাই স্বাভাবিক। না
থাকাটাই বরং লজ্জার ব্যাপার।
মহিবুল্লা পান্নার কথায় অবাক হয়ে যায়, কি বলছো এসব?
তোমারতো দেখছি নিজেই লজ্জা শরমের বালাই নেই।
তোমারতো ভাষারও ঠিক নেই, পেঁপেকে বলছো ভিটামিনধারী
আবার আমাকে বলছো বুইড়া, এসব কি?
ভুল হয়ে গেছে।
তুমি জানো নাইনটিন এইটিতে আমার একটা উপন্যাস বের
হয়। তারপর আর নানা ঝামেলায় লিখতে পারিনি। আমার
উপন্যাসটা সম্বন্ধে জানো ?
Ñকীভাবে জানবো চাচা? তখনতো আমার জš§ই হয়নি। সেটা
আমার দোষ নাÑআমার বাবার দোষ।
তোমার বাবার দোষ মানে ?
মানে চাচা, আমার বাবা যদি আগে বিয়ে করতেন তা হলে
আমি আগে জš§ নিতাম। আপনার উপন্যাস সম্বন্ধে জানতে
পারতাম।
তুমি দেখছি মহা ফাজিল! এই তুমি যাও। আমার সামনে
থেকে যাও! পান্না ভয়ে উঠে দাঁড়ায়।
পেঁপে নিয়ে যাও। যাও
পান্না পেঁপে নিয়ে দ্রুত ভেগে যায়। মহিবুল্লা রাগে ফুসঁতে
থাকেন, আনকালচারড! আমি বুঝিনা কেন পেঁপে এনেছে ?
আমার জামাই হতে চায় সবাই। জামাইতে একেবারে গিজগিজ
করছে চারদিকেÑ
ভিতর থেকে মহিবুল্লার বেগম সাহেরা বেরিয়ে আসে।
সাহেরা স্বামীকে মহা উত্তেজিত দেখে জানতে চায়, কী হ’ল
রাগারাগি করছো কার সাথে ? ও মাঃ ঘরেতো কেউ নাই।
মহিবুল্লা জানায়, চিন্তা করো কতবড় আহাম্মক! আমার কোষ্ঠ
কাঠিন্যের চিন্তায় অস্থির। পেঁপে নিয়ে এসেছে। আরে কোষ্ঠ
কাঠিন্য তোর বাবার হউক।
৩.
শরিফুল টেলিফোন করে নবনীর কাছে। তার চিত্ত অস্থির হয়ে
আছে।

আমি শরিফুল
নবনী শরিফুলের পরিচয় দেয়া শুনে হাসে, পরিচয় দিচ্ছ? কেমন
আছ? দেখেছো কী সুন্দর রাত! একটু পরেই চাঁদ উঠবে
চাঁদ উঠবে জানি। কিন্তু আপাতত আমি চারদিকে অন্ধকার
দেখছি।
কেন ?
তোমার বাবার জন্য। তুমি আমাকে একটা বুদ্ধি দাও কীভাবে
সংস্কৃতমনা হতে পারিÑ
সেটা বিভিন্নভাবে হতে পারো। গান শিখতে পারো, গল্প লিখে
দেখিয়ে দিতে পারো বা নাটক লিখে প্রমাণ করতে পারো তুমি

সংস্কৃতমনা মানুষ। তুমি সংস্কৃতি চর্চা করো।
Ñকি বলছো? আমি এখন গান শিখবো? গানের গলা আছে
আমার?
গলা নেই ?
গলাতো আছেই। তবে সেটা শুধু ভাত খাবার জন্য।
তাহলে সাহিত্য চর্চা শুরু করো।
যাক ভাগ্য ভালো নাচ শিখতে বলোনি।
আমার উপর কোন কিছুর জন্য দোষ দিওনা।
কী করবো ?
বাবার কাছে দ্রুত প্রমান করো তুমি সংষ্কৃতমনা।
আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না? তুমি বাবার উপন্যাসটা
নাট্যরূপ দাও তাহলে বাবাকে পটাবার একটা সুযোগ পাবে।
Ñসংষ্কৃতমনা ভাববে। তাইতো? বুদ্ধিটা মন্দ না।
Ñবলবে-বইটা তুমি টিভি সিরিয়াল করবে। আর নাট্যতত্ত্ব নিয়ে
বড় বড় কথা বলবে।
নাট্যতত্ত্ব কোথায় পাবো ?
আরে বই পড়তে হবে। বই বই। নবনীর বিরক্ত গলা শোনা
যায়।
Ñআমার বংশের কেউ নাট্যরূপ দেয় নাই। কিন্তু সেটাতো আমি
করতে পারবো না। তখন উনি কী মনে করবেন?

একবার বিয়ে হয়ে গেলে তখন আর বাবার কিছু করার থাকবে না।
বিয়ের আগেই শ্বশুরের সাথে ফ্রডগিরি? বলে বেড়াবেন,
জামাই টাউট।
কেন পৃথিবীতে কি কোন জামাই শ্বশুরকে চিট করে নাই?
নবনী বোধ হয় রাগে ফোন কেটে দেয়। শরিফুল শুয়ে আবার
আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে।
৩.
পান্না হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে ঠিকই একদিন তার কবি বন্ধু
বৃক্ষ কামালকে নিয়ে নবনীদের বাসায় এসে হাজির হয়।
মহিবুল্লা পেপার পড়ছিলেন। এমন সময় দরজায় ঠুক ঠুক।
মহিবুল্লা উঠে দরজা খুলে দেখে পান্না আর বৃক্ষকামাল। মহিবুল্লা
একটু অপ্রীতিকর স্বরেই বলেন, আবার এসেছো ?
না-না-চাচা আমি একলা আসি নাই। আমার বন্ধুকেও নিয়া
আসছি।
এসো ভিতরে। যত্তসব।
দুজন ভিতরে এসে বসে। মহিবুল্লা জানতে চান, আজ আবার
পেঁপে টেপে আনোনিতো ?
না না চাচা।
এই পান্না, তোমাকে ছোট বেলা থেকে চিনি। তুমিতো ভাল
ছেলে ছিলে এখন কেন এমন হয়ে গেছ? কাজকর্ম কিছু করো
নাকি পেঁপে নিয়ে বাসায় বাসায় দৌঁড়াও?
জ্বী চাচা-আমিতো কন্ট্রাকটরী করি।
এ কে? বৃক্ষ কামালকে দেখিয়ে জানতে চান।
আমার বন্ধু। বৃক্ষ কামাল।
নাম শুনে মহিবুল্লা আঁৎকে ওঠেন, মানে? এটা তোমার মা বাবার
দেয়া নাম?
না-না, এটা আমার কবি নাম। বৃক্ষ কামাল ব্যাখ্যা দেয়।
পান্না বুঝিয়ে দ্যায়, ও গাছ নিয়ে কবিতা লিখেতো, তাই ওই
নিজের নাম নিজে দিয়েছে বৃক্ষ কামাল। আসলে ওর নাম,
কামালউদ্দিন হাওলাদার। নারে কামাইল্যা?

মহিবুল্লা পান্নাকে থামিয়ে দ্যান, এই তুমি এতো কথা বলছো
কেন? বৃক্ষ কামালের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলেন, ও তুমি
কবিতা লেখ? চমৎকার! বেশ সংস্কৃতমনা ছেলে।
বৃক্ষ কামাল বিগলিত হয়ে বলে, জ্বী।
মহিবুল্লাও উৎসাহিত হয়ে নিজের কীর্তি জাহির করেন, জানোতো
নাইনটিন এইটিতে আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলাম,
বুঝেছোতো উপন্যাসÑআমার আঙ্গিকটা একেবারে নতুনÑ
বৃক্ষ কামাল বুদ্ধিজীবী ভাব নিয়ে উৎসাহিত কন্ঠে বলে, আঙ্গিক
নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছিলেন বুঝি ? আসলে সেই ধরুন

বোদলেয়ার থেকে শুরু করে হালের পাওলো কোয়েলহো আঙ্গিক
নিয়ে পরীক্ষা করেছেন।
মহিবুল্লা বৃক্ষ কামালের এ কথায় মহা খুশি হ’ন, আরে বাবা তুমি
দেখছি সত্যি জানাশোনা ছেলে। আমিতো এমনটাই চাচ্ছিলামÑ
বৃক্ষ কামাল মাথা প্রায় নুইয়ে বলে, জ্বী চাচা। সে এখন বিনয়ের
অবতার।
মহিবুল্লা এবার একটা কান্ড করে বসেন, এই নবনী নবনী দ্যাখ
কে এসেছে, বলতে বলতে উঠে যান ভিতরে।
মহিবুল্লা ভিতরে যাওয়ার পর পান্না বৃক্ষ কামালকে হাত মুচড়ে
ধরে, ঐ বোদলেয়ার কি তর মামা হয়? তার কথা তুললি ক্যান?
তরে এত কথা কইছে কে? কথা কমু আমি। বোদলেয়ার মইরা
গেছে কবে। আল্লা তারে বেহেস্ত নসীব করছে তারে লইয়া
টানাটানি করছ ক্যান?
বৃক্ষ কামাল পান্নার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,
আরে তারাতো অমর। তাদের কথা বলবো না ?
পান্না আরও রাগে, থাকুক অমর। এতো দেখছি তরে আইন্যা
খাল কাইটা কুমীর আনলাম।
মহিবুল্লা নবনীকে ধরে নিয়ে আসে ড্রয়িং রুমে। পান্না তাড়াতাড়ি
বৃক্ষ কামালের হাত ছেড়ে দেয়।
মহিবুল্লা নবনীকে দেখায়, দ্যাখ ইনি কবি। দেখেই বোঝা যায়
তাই না মা ? হে হে।

বৃক্ষ কামাল নবনীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। নবনী বিরক্ত
চোখে তাকায় এবং মাথাটা একটু সালামের ভঙিতে নোয়ায়।
মহিবুল্লা নবনীকে বলে, বস মা। এতদিন একজন যোগ্য মানুষের
দেখা পেয়েছি। তা বাবা কি বলছিলে যেন আঙ্গিক নিয়ে?
নবনী মহিবুল্লার পাশে বসে। বৃক্ষ কামাল তার ঝোলাটা খোঁজা
শুরু করে, কথা বলার আগে বরং একটা আমার লেখা কবিতা
পড়ুন এখানেও আমি আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা করেছি।
পান্নার ইচ্ছা করে বৃক্ষ কামালের গলায় একটা বটি দাও বসিয়ে
দ্যায়। কিন্তু আপাতত সে কিছু করতে পারেনা।
মহিবুল্লা উৎসাহিত হ’ন, হ্যাঁ হ্যাঁ সেটাই ভাল হবে।
বৃক্ষ কামাল নিজের সাইড ব্যাগ খুঁজে একটা কবিতা লেখা কাগজ
নবনীর দিকে বাড়িয়ে ধরে, নিন পড়ুন। পান্না আর সহ্য করতে
পারেনা। থাবা দিয়ে বৃক্ষ কামালের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে
নেয়।
মহিবুল্লা অবাক হ’ন, আহ আহ! কি হল?
পান্না গোয়ারের মত বলে, কিছু হয় নাই। চাচা আপনি ওর
কোন কথা শোনবেন না। ওই একটা হাবাইত্যা। আমার থেকে
মাঝে মধ্যে টাকা নেয় আর দেয় না। খাইতেও পায়না। ওর
কোষ্ঠকাঠিন্য আছে।
মহিবুল্লা বিরক্ত হয়ে বলেন, তুমি দেখছি সবাইকে রোগী বানিয়ে
ফেলতে চাও।
বৃক্ষ কামাল মহিবুল্লার দিকে কৈফিয়ত দেয়, চাচা ও আমার বন্ধু।
আমি কিছু মনে করিনা যা খুশি ও বলে বলুক আমি আকাশের
মত উদার।
পান্না হাত ধরে টানতে থাকে, এ্যাই তুই চল ওঠÑ
মহিবুল্লা অবস্থা বেগতিক দেখে সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন, সেই
ভাল এখন পরিস্থিতিটা অন্যরকম হয়ে গেল। ঘোলাটে। বৃক্ষ
কামালকে বলেন, তোমার মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে যাও। আমি
তোমাকে রিং দিব। এসো কিন্তু. . .
বৃক্ষ কামাল তাড়াতাড়ি কার্ড বের মহিবুল্লাকে দেয়। পান্না
ততক্ষণে বৃক্ষকে টানতে শুরু করেছে।
বৃক্ষকে পান্না টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যায়। নবনী হেসে
ফেলে। মহিবুল্লা নবনীকে বলেন, দেখলি মা এদের কান্ড?
আসলে কি, কবি ছেলেটাকে পান্না সহ্য করতে পারছিল না। ওর
আসলে মেন্টাল চিকিৎসা দরকার।

পান্না বাইরে এসে বৃক্ষকে আবার ধরে, ঐ তুই এত কথা বলতে
গেলি ক্যান?
বৃক্ষ কামাল বলতে চায়, আমি আঙ্গিক নিয়ে. . . .
পান্না শক্ত করে বৃক্ষের হাত ধরে বলে, রাখ তর আঙ্গিক। তুই
কার্ড দিলি ক্যান?
বৃক্ষ কামাল জানায়, উনি চাইলেন যেÑ
চাইলেই দিতে হইবো? কার্ড আবার কবে ছাপালি? উঃ খাইতে
নাই বাটি আবার হুইতে রাঙ্গা পাটি। এক্কেরে দিমু!
বৃক্ষ কামাল নীরিহ মুখে বলে, তুই নিয়া আসলি আবার তুই
রাগারাগি করছিস?
নাহ তোমারে জামাই আদর করবো! শোন, তুই আর এই
বাড়ির তিন সীমানায় আসবি না।
৪.
পান্নারা বের হয়ে যাওয়ার পরই নবনী শরিফুলের কাছে ফোন
করে, কী কিছু হ’ল?
গতকাল আমাদের পড়ার পান্না ভাই এক কবিকে নিয়ে এসেছিল
আমাদের বাসায়। বাবাতো ঐ কবির কথা শুনে মুগ্ধ। বাবা বলছিল
এতদিন পরে নাকি যোগ্য মানুষ খুঁজে পেয়েছে। আমারতো ভয়ই
করছে শেষে বাবা না আবার ওকেই বিয়ে করতে বলে।
তোমার কেমন লেগেছে ঐ কবিকে সেটা বলো।
ভালোইতো! আর জানো হ্যাংলা চোখে আমার দিকে
তাকাচ্ছিল হা হা হা……
ওর পা আমি ভেঙে দিব। ফাজিল।
ব্যাস, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? মাথা গরম।

কিন্তু বৃক্ষ কামালের আলু-ইন্দ্রিয় মহিবুল্লার বাড়িতে আসার পর
গল্প
তার মস্তিষ্কে কল্পনার ডালপালা ছড়াতে লাগলো। সে ঝপাঝপ
কিছু কবিতা লিখে ফেললো। কিন্তু কবিতায় এবার গাছের তথা
বৃক্ষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে যুবতীদের দেহ সৌষ্টবের বেশ মিল
দেখা দিল। কবিতায় ছিল গাছে ফল ধরা সংক্রান্ত বিবরণ,
‘পশ্চাৎভূমি যেন নন্দনকানন’ বা ‘কলাগাছের গভীরে মিলিয়ে যায়
স্বপ্নরেখা’ ইত্যাদি জাতীয় বিষয়। বৃক্ষ কামালের আলু-ইন্দ্রিয়ের
তাড়নাই দু’ একদিন পর তাকে মহিবুল্লার বাসায় হাজির করলো।
মহিবুল্লা কবি দর্শনে মহাখুশি হলেন। সাদরে তাকে অভ্যর্থনা
জানান, এসো বাবা এসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
সামালেকুম চাচা। আমরা যারা লেখালেখি করি তারাতো
আসলে শুভ আর মঙ্গলের জন্যই অপেক্ষা করি।
মহিবুল্লা পুরোপুরি কাত, অসাধারণ বলেছো। তোমার কথাগুলি
আমার কাছে কথা নয়, বাণী বলে মনে হচ্ছে।
বৃক্ষ কামালও নুইয়ে পড়ে, না না আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন। আমি
আসলে কিছুই জানিনা। জ্ঞানের সমুদ্র তীরে নুড়ি কুড়াচ্ছি মাত্র
মহিবুল্লাপ্রায় ডগমগো করেন, এই দ্যাখো বলছিলাম না, কথা
নয় বাণী।
দুজনে সোফায় মুখোমুখি বসে।
মহিবুল্লা অতি আগ্রহের সঙ্গে বলেন, তোমার কবিতা কিন্তু আজ
শুনবো।
অবশ্যই শুনবেন। কবিতা আমার কাছে কবিতা নয়। বৃক্ষের
ছায়া।
মহিবুল্লা মুগ্ধ হয়ে হা করে বৃক্ষ কামালের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
মহিবুুল্লা খামাখ্যা জানতে চান, বৃক্ষের ছায়া?
এই জন্যইতো আমার নাম বৃক্ষ কামাল।
জানো আমার উপন্যাসে
আপনি উপন্যাসও লিখেন নাকি? বাঃ বৃক্ষ কামাল মহিবুল্লাকে
কথা শেষ করতে দেয়না।
এখন লিখি না। নাইনটিন এইটিতে লিখেছিলাম. . . .বুঝলে
তখন উপন্যাসের আকাল যাচ্ছে তখনই. . . .

আপনি লিখে ফেলেছিলেন. . . .বুঝেছি
এগজাক্টলি। উপন্যাসের প্রতিটা পাতায় . . .
বৃক্ষ কামাল আগ বাড়িয়ে বলে, পাতায় পাতায় শিহরণ
এগজাক্টলি . . . .বুঝলে
বৃক্ষ কামাল আচমকা জানতে চায়, নবনী কোথায়? ওনাকে দেখছি না যে!
আছে বাসায়। কি করছে ভিতরে কে জানে? দাঁড়াও ওকে ডাকছি ও শুনুক
আমাদের আলোচনা।
বৃক্ষ কামাল জোর দিয়ে বলে, শোনা দরকার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা।
নবনী নবনী মা এদিকে আয়, মহিবুল্লা গলা ছেড়ে ডাকেন।
পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকে নবনীর মা সাহেরা বেগম। উনি আবার ‘বলো বীর উন্নত
মম শির’ টাইপের মহিলা।
তোমাকে না। নবনীকে ডেকেছি আমাদের আলোচনা শোনার জন্য।
সাহেরা জানান, নবনীর কাজ আছে ও আসতে পারবে না। আমিই তোমাদের
আলোচনা শুনি।
মহিবুল্লা অবাক হ’ন, তুমি আলোচনা শুনে কী করবে?
সাহেরা বেগমের রক্ত মাথায় চড়া শুরু করে, তুমিই বা এই বুড়ো বয়সে আলোচনা
করে কী করবে?
মহিবুল্লা একটু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চান, বাজে কথা বলবে না বলছি।
সাহেরা বেগম স্বরূপে আবির্ভূত হ’ন, উচিৎ কথা বললেই গায়ে লাগে। এবার বৃক্ষ
কামালকে লক্ষ্য করে বলেন, এই পোলা কী করো তুমি? তোমার কামকাইজ
নাই?
বৃক্ষ কামাল ভয় পেয়ে উঠে দাড়াঁয়, চাচা আমি আজ আসি। আরতো আলোচনার
পরিবেশ নাই।
নাম কী তোমার? কোথায় থাকো?
নাম বৃক্ষ কামাল
কী ! বৃক্ষ? কামাল?
জ্বী।
এ্যাই পোলা কী কইলা? কী? পরিবেশ নাই? আমি পরিবেশ নষ্ট করছি?
বৃক্ষ কামাল দ্রুত বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সাহেরা এবার স্বামীকে নিয়ে পড়ে, দেখো তোমারে আমি স্পষ্ট করে বলে

দিতাছি, ওই চুইল্লা পোলার সাথে আমি মাইয়ার বিয়াশাদী দিবনা। ওর মাথায়
উকুন। খোঁজ নিয়া দেখো, ছয় মাসে একবার গোছল করে কি না সন্দেহ! ঘন
ঘন আসা শুরু করছে। তুমি বোঝ কোন কিছু?
মহিবুল্লা কিছুটা সামাল দিতে চায়, একটা মানুষ সম্বন্ধে না জেনে বুঝে কথা বলা
ঠিক নয়।
সাহেরা রাগে গনগন করে, নামের কি ছিড়ি! বৃক্ষ কামাল। তুমি কি মনে করো
এইটা ওর বাপ মার দেয়া নাম? ফাজিল পোলা! নিজের নামও নিজে পাল্টাইয়া
ফালাইছে।
মহিবুল্লা কন্ঠে মুগ্ধতা নিয়ে গিন্নিকে বোঝাতে চায়, কবি সাহিত্যিক, সিনেমার
নায়ক নায়িকারা কয়জন বাপ মার দেয়া নাম রাখে? দেখোনা সিনেমার নায়ক
নায়িকারা দিলীপ কুমার, তপন কুমার, মধুবালা. শাবানা, রোজিনা . . …..সবাই
আসল নাম পাল্টে ফেলেছে। সংষ্কৃতমনারা এই রকমই করে।
Ñনায়িকাদের নামতো দেখি মুখস্থ!
কিন্তু মহিবুল্লার বাড়ির বাইরে তখন আরেক নাটক চলছিল। মহিবুল্লার বাড়ি
থেকে বের হতেই কবি বৃক্ষ কামাল ফট করে রাইভাল পান্নার হাতে কট হয়ে
যায়। পান্না সব কাজ ফেলে নবনীদের বাড়ির উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখার
একটা পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেটা কবির জানা ছিলনা। সে ফাঁকা মাঠে
গোল দিয়ে চলে যাবে বলে ভেবেছিল।
বৃক্ষ কামাল রাস্তায় বেরিয়েই পান্নার সামনে পড়ে। পান্না এতেক্ষণ নবনীদের
বিপরীত দিকে দাঁড়িয়েছিল। কামালকে বেরিয়ে আসতে দেখেই ধরার জন্য
সামনে এসে দাঁড়ায়, ঐ তুই আবার এই বাসায় ঢুকছস যে? তরে না কইছি এই
বাড়ির ত্রিসীমানায় আসবি না?
বৃক্ষ কামাল খানিকটা ভয় খায়, এটা কিন্তু তোর অন্যায় হচ্ছে। আমার সাথে
রাগারাগি করছিস কেন? নবনীর বাবা আমাকে আসতে বলেছিল।
পান্না বৃক্ষ কামালের হাত ধরে শক্ত করে। বৃক্ষ ভয় পায়। পান্না গোয়ারের মত
বলে, ওনারতো স্ক্রু ঢিলা। ওনার কথা মত আসতে হইবো? নাকি নবনীর লগে
দেখা করনের খায়েশ হইছে?
বৃক্ষ কামাল আকাশ থেকে পড়ে, এসব কী বলছিস?
ঠিকই বলতাছি।
তুইতো জানস আমার প্রেম শুধু বৃক্ষের সাথে।

এইবার মানুষের লগে করবার চেষ্টা করতাছো?
না না।
না মারাও? তুই গেলি ক্যান নবনীগো বাসায়? কবিগো আমি চিনি না? এক
একটা মিনমিনা শয়তান। মাইয়া পটানোর ওস্তাদ।
এটা কিন্তু বেশী বেশী হয়ে যাচ্ছে।
চেচাঁমেচি শুনে মহিবুল্লা বেরিয়ে আসেন। তিনিও ঘটনাটা দেখেন ও ঘাবড়ে
যান।
পান্না তখন রাগ সপ্তকে, বেশী কারে কয় আউজগা বুঝামু। বলেই পান্না
রাস্তোর পাশের একটা গাছের শুকনা ডাল ভেঙে কবি বৃক্ষ কামালের মাথায়
বসিয়ে দ্যায়। বৃক্ষ কামালের মাথা ফেটে কিঞ্চিত রক্ত বের হতে থাকে।
আঘাতের চাইতেও ভয়ের চোটে জ্ঞান হারায়। কবি মানুষ এমনিতেই শরীরে
ভিটামিনের অভাব। চারদিকের মানুষ দৌঁড়ে আসে। পান্নার ভাগ্য খারাপ।
ঐ সময় কাছাকাছি এক দল টহল পুলিশ যাচ্ছিল। তারা পান্নাকে ধরে নিয়ে
গেল। মহিবুল্লা দ্রুত ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েন। তিনি দরজা বন্ধ করে পরম
আতঙ্কে ভাবতে থাকেন, এ ঘটনার জন্য তিনিই দায়ী। সংস্কৃতমনা জামাই
খুঁজতে গিয়ে এখন খুন খারাপি শুরু হয়ে গেছে। তিনি মেয়ে এবং মেয়ের
মাকে ডেকে এনে ঘটনার আদ্যপান্ত বলেন। মহিবুল্লা বেশ আতঙ্কিত হয়ে
বলেন, এখনতো পুলিশ যদি এ ঘটনার তদন্ত শুরু করে তা হলেতো নাটের
গুরু হিসাবে আমাকেই ধরবে। কারণ আমি তোর জন্য সংস্কৃতমনা বর
খুঁজছিলাম বলেই এ ধরনের সংঘর্ষ ঘটে গেল।
মেয়েকে বলেন, তোর কোন পরিচিত ছেলে আছে?
নবনী জানতে চায়, কেন?
Ñনা মানে এই ধর, এমন ছেলে যে নাকি তোকে বিয়ে করতে চায়।
নবনী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা। বাবার এ প্রশ্নে সে মনে মনে
খুবই পুলকিত হয়।
নবনী বাবাকে লাজুক ভঙিতে বলে ফেলে, আছে। আমার একজন পছন্দের
মানুষ।
মহিবুল্লা স্বস্তির শ্বাস ফেলেন, বাঁচালি মা। অন্ততঃ পুলিশ এলে বলা যাবে যে,
আমি এসবের মধ্যে নাই…
সাহেরা বেগম মেয়ের কাছে জানতে চায়, ঐ কোনো চুইল্লা পোলা নাতো?