মনোজিৎকুমার দাস
ভো র হচ্ছে বুঝতে পেরে সুনন্দার মনে একটু একটু স্বস্তি
ফিরে আসছে। সে রাতভর এক ধরনের আতঙ্কের
মাঝে কাটিয়েছে তার এক কালের শ্বশুরবাড়িতে। অফিস ছুটি
হলে সুনন্দা বনগাঁও লোকাল ধরে সন্ধ্যে সন্ধ্যে বাড়িতে পৌঁছে
থাকে। মধ্যমগ্রামে বদলি হয়ে আসার পর থেকে সুনন্দা এটাই
করে আসছে। কিন্তু ওদিন রমেশদার দোকানের কাছে আসতেই
শ্রাবণের বৃষ্টি শুরু। অগত্যা রমেশদার দোকানে আশ্রয় নেয়া।
বনগাঁও লোকাল ধরতে হলে বৃষ্টির মাঝে দৌড়েও ট্রেন ধরা যাবে
না, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে দু’একটা রিক্সা চলাচল করলেও শত চেষ্টা
করেও একটা রিক্সাকেও সুনন্দা দাঁড় করাতে ব্যর্থ হলে রমেশ
নিজেও রিক্সা থামাতে পারল না।
‘ট্রেনের অভাব নেই , বৃষ্টি ধরলে আমি না হয় ট্রেনে তুলে দিয়ে
আসব, দিদি। ‘দাদার সঙ্গে বৌদির ডিভোর্স হবার পর রমেশ
সুনন্দা বৌদিকে দিদি বলে ডাকে। সে ভেবে পায় না এমন
মেয়ের সঙ্গে দাদার বনিবনা হল না। বৃষ্টি থামার নাম নেই দেখে
পার্সের ভেতর থেকে ফোনটা বের করে মাকে জানায় সুনন্দা,
‘বৃষ্টিতে আটকে রমেশদার দোকানে বসে আছি। এদিকের যা
অবস্থা একলা আমি শেষ ট্রেন ধরব ?’
‘রমেশ তো বউ বাচ্চা নিয়ে ওখানেই থাকে। তোর বিয়ের পর
পরেশ তাদের মধ্যমগ্রামের বাড়িতে থাকতো। তুই রাতটা
রমেশের ওখানে থাক। বিপদে নিয়ম নাস্তি। রমেশের বউ
তোকে ভাল জানে ‘মায়ের কথা শুনে সুনন্দা ভাবে, ওখানে থেকে
যাওয়া কি ঠিক হবে ? কাল রবিবার, ভোরের ট্রেন ধরে সে বাড়ি
ফিরবে। ওই বাড়িকে ঘিরে তার বিবাহিত জীবনের কত স্মৃতি
যে জড়িয়ে তা আছে——-। সুনন্দা আর ভাবতে পারে না।
বৃষ্টি থামলে রমেশ দোকান বন্ধ করার আগে সুনন্দাকে বলে,
‘আমাদের ওখানে চল দিদি।’ অগত্যা সে এক সময়ের দেওর
রমেশের সঙ্গে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে কিনা ভাবতে থাকে।
সুনন্দা ইতস্তত ভাব দেখালে রমেশ বলল, ‘দিদি তুমি ভেব না।
দাদা সঙ্গে তোমার দেখা হওয়ার কোন আশংকা নেই। ‘রমেশ
ভাবল, দাদা বাড়িতে নেই অনেকদিন, কোথায় বর্তমানে আছে
তা কেউ বলতে পারে না।
বাবার কাছেই সুনন্দার গান শিক্ষার হাতেখড়ি। মধ্যমগ্রামে থ
াকাকালে সুনন্দার বাবা সুভেন্দু দাস অবসর সময়ে গান বাজনা
নিয়েই থাকতো। সে সময় সুভেন্দু দাস মধ্যমগ্রাম পৌরসভার
সচিব পদে কাজ করতেন। সুনন্দার জš§ মধ্যগ্রামের বাসায়।
গোবরডাঙ্গার পৈত্রিক বাড়িতে সুনন্দার কাকারা থাকেন।
পরেশের বাড়ি মধ্যগ্রামে হলেও পরেশরা এক সময় তার বাবার
চাকরির সূত্রে কলকাতার কালীঘাটে থাকত। সুন্দদা ও পরেশের
বিয়ে কিন্তু হয়েছিল মধ্যমগ্রামের বাড়িতে, কারণ, তখন পরেশের
বাবা অবসর নেওয়ায় তিনি দেখলে বাসা ভাড়া নিয়ে কলকাতায়
থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই। পরেশেরে সঙ্গে সুনন্দার সেটেল্ড
ম্যারেজ বললেও আসলে তাদের বিবাহিত পূর্ব জীবনে তারা
পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত ছিল প্রগাঢ় ভাবেই। সুনন্দা সুন্দরী,
ভাল গান গায় এবং অভিনয়েও পারদর্শী। অন্যদিকে, পরেশের
চেহারাও সুন্দর, কথাবার্তায় চৌকোষ। স্টার থিয়েটারে সুনন্দার
পরিচয় হয় পরেশের সঙ্গে। এক সময় সুনন্দা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়
করলেও এক সময় পরেশের জন্যেই সে নায়িকা হওয়ার সুযোগ
পায়। রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি গীতিনাট্যে পরেশ ও সুনন্দা
মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার পর পরেশের সঙ্গে সুনন্দার চেনাশোনা
প্রগাঢ় হতে থাকে। অভিনয়ে দু’জনের নামডাক হওয়ার আগেই
পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরেশের সঙ্গে সুনন্দার বিয়ে
হলে সবচেয়ে খুশি হয় সুনন্দা।
সুনন্দার সাত বছরের বিবাহিত জীবন সুখের ছিল। তারা দু’জনে
এক সঙ্গে মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতার থিয়েটার পাড়ায় যাতায়াত
করতো। বেশ কয়েকবার তারা লোকনৃত্য অংশ গ্রহণ করতে
মুর্শিদাবাদ এবং ইস্পাত নগরী দুর্গাপুরে গিয়েছিল। তারা এক
সঙ্গে লোকনৃত্যে নেচেগেয়ে আসর মাতিয়ে তুললেও কিন্তু
সুনন্দা কখনোই থিয়েটারের বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারেনি
পরেশকে। তবে পরেশকে সুনন্দার ভাল লাগতো। সে কোন
দিনই কল্পা করেনি একদিন সে পরেশের বউ হবে। কিন্তু সেটাই
হল একদিন। তখনো সুনন্দার মা বেঁচে, তবে সে কয়েক মাস
অসুস্থ হয়ে শয্যশায়ী। সুনন্দার মা তার বাবাকে বলল, ‘মরার
আগে সুনন্দার বিয়েটা দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে
পারতাম। পরেশ ছেলেটা তো এক সঙ্গে কলকাতায় অভিনয়
করে। ওই ছেলেটা সঙ্গে আমার সুনন্দা মায়ের বিয়ে হলে কেমন
হয় সুনন্দদার বাবা।’ সুনন্দার মায়ের কথাটা তার মনে ধরে।
সুনন্দাকে পরেশের ভাল লাগলেও সুপ্রিয়া নামের একটা মেয়ের
প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা এখনও আছে। মেয়েটি তার স্কুল
বান্ধবী থেকে একদিন প্রিয় বান্ধবী হয়ে উঠে। পরেশের চেয়ে
এক ক্লাস নিচে পড়তো সুপ্রিয়া। পরেশ ও সুনন্দা স্কুলের পাঠ
শেষ করে এক কলেজে ভর্তি হয়। বার ক্লাস শেষ করার আগেই
পরেশ ও সুনন্দার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গাঢ় হল। তারা ঠিক করল
কলকাতার নাম করা কলেজে একই বিষয়ে পড়বে বলে তার ঠিক
করে। কিন্তু তাদের আশা ব্যর্থ হয়ে যায় হঠাৎ করে সুপ্রিয়ার বাবা
সুকোমলবাবু বোম্বাইতে বদলি হয়ে যাওয়ায়। সুপ্রিয়া কলকাতা
থেকে চলে গিয়ে বোম্বাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স
এ ভর্তি হলে পরেশ এক এক বার ভাবে, ‘আগে সিদ্ধান্ত নিলে
সেও বোম্বে চলে যেতে পারতো। পরেশের মা জানতো পরেশ
সুপ্রিয়াকে ভালবাসে। কথাটা পরেশই তার মাকে বলেছিল।
এর বেশি বলবার সাহস করেনি পরেশ। পরেশরা গোবরডাঙ্গার
আদি বাসিন্দা। আসলে তারা ঘটি, অন্যদিকে পরেশরা পূববাংলা
থেকে আসা রিফিউজী। পরেশের মায়ের সন্দেহ ছিল সুপ্রিয়া
তাদের পাল্টি ঘর কিনা।
বোম্বে যাওয়ার পর পরেশের সঙ্গে সুপ্রিয়ার ঘনিষ্টতা আর থাকার
কথা নয় এটা ভেবে পরেশের মা স্বস্তিবোধ করলেও কিন্তু পরেশ
সুপ্রিয়ার কথা ভুলতে পারে না। সে স্ব শরীরে বোম্বে যাওয়ার কথা
ভাবে। টেলিফোনে সে সুপ্রিয়ার সাথে যোগাযোগ করে, কিন্তু সুপ্রিয়া
আগের মতো তার সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহী নয় পরেশ বুঝতে
পারে। কয়েকদিন পরে রাত বারটা দিকে সুপ্রিয়া টেলিফোনে
পরেশকে যা বলে, ‘তুমি আমার আশা ছেড়ে দাও। আমার বিয়ের
কথা চলছে বোম্বে প্রবাসী কলকাতার এক বনেদী ঘরের ছেলের
সঙ্গে। ছেলে একটা বড়সড় মাল্টিন্যশনাল আইটি এন্ট্রারপ্রাইজের
এক্সিকিউটিভ।’ জবাবে পরেশ কী বলবে ভেবেই পায় না!।
সুনন্দা নামের মেয়েটিকে পরেশের মার ভাল লাগে। একবার
কলকাতায় গিয়ে পরেশের মা রবীন্দ্রসদনে পরেশ ও সুনন্দার
অভিনয় দেখে পরেশের মনে আশা জাগে সুনন্দার সঙ্গে পরেশের
বিয়ে হলে ভালই হবে।
পরেশের সঙ্গে পরামর্শ না করেই এক সময় পারিবারিক ভাবে
সুনন্দার সঙ্গে পরেশের বিয়ের প্রস্তাব দেয় পরেশের বাবা মা।
পরেশ এ খবরটা জেনে প্রথমে সুনন্দাকে বিয়ে করতে অস্বীকার
করে। সে বলে, ‘যার সঙ্গে নাটকে বরবধূর অভিনয় করি তাকে আমি বিয়ে
করতে পারি না। পরেশ তখনও সুপ্রিয়ার সেদিনের কথা সুনন্দার মনে পড়ে।
তারপর থেকে পরেশের মধ্যে বাউণ্ডেলাপনা দেখা যায়। পরেশের বাবা ও মা
সুনন্দার সঙ্গে পরেশের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। সুনন্দার
বাবা মা পরেশের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়। বেশ জাকজমকের
করে পরেশের সঙ্গে সুনন্দার বিয়ে হয়। পরেশ সুনন্দার সঙ্গে নাটক করা বন্ধ
করে দেয়। কিছুদিন যেতেই সুনন্দা বুঝতে পারে তার স্বামী পরেশ সুপ্রিয়াকে
ভুলতে পারেনি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরও গড়িয়ে যায়।
এক সময় পরেশ জানতে পারে সুপ্রিয়ার বিয়ে হয়েছে মাল্টিন্যশনাল আইটি
এন্ট্রারপ্রাইজের এক্সিকিউটিভ এর সঙ্গে।
একদিন পরেশ কলকাতার অভিনয় ছেড়ে বোম্বে পাড়ি জমায় এক সময়। সুনন্দা
বুঝতে পারে, তার স্বামী পরেশ উচ্চাকাঙ্খী। বিয়ের পর পর পরেশ সুনন্দার
সঙ্গে ভাল ব্যবহার করোয় সুনন্দা মন থেকে সব রকমের অস্বস্তি দূর হয়ে যায়।
পরেশের মাও খুশি হয়। তাদের সুখ কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় না। পরেশ বোম্বে
গিয়ে শত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু করতে পারে না। পরেশ ভাবে,
কলকাতায় ফিরে গিয়ে সুনন্দার সঙ্গে সে ঘর সংসার করবে। কিন্তু বিধিবাম,
পরেশ বাড়ি ফিরে এলো। সুনন্দা বাপের বাড়িতে, পরেশের অনুপস্থিতিতে
তার বাপের বাড়িতেই থাকারই কথা। পরেশ বাড়িতে এসে দেখল তার বাবা
মা দু’জনেই মরণাপন্ন। আজ মরে তো কাল মরে। পরেশের ছোট ভাই রমেশ
পড়াশোনা বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরেছ। শ্বশুর শাশুড়ি মরণাপন্ন, এ কথা
শুনে সুনন্দা বাপের বাড়ি গোবরডাঙ্গা মধ্যমগ্রামে এসে বাড়িতে পরেশকে দেখে
হতবাক হয়! সে পরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মনে হয় বোম্বে
থাকাকালে সে গাজা মদ আর মেয়ে মানুষ বাদ দেয়নি।
পরেশের উপর সুনন্দার রাগ হয়, যে স্বামী নিজের বউকে অজলে অস্থলে ফেলে
রেখে পালিয়ে যেতে পারে, সে নিজের বাবা মাকে দেখে না সেই স্বামীর সঙ্গে
সুনন্দা সহবাস করতে পারবে না কোনক্রমেই। কয়েকদিন পরে সুনন্দার শ্বশুর
শাশুড়ি মারা যায়। অন্তেষ্টিক্রিয়ার সব কিছুই রমেশ করে।
অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষে সুনন্দা বাপের বাড়িতে ফিরে যায়। পরেশ সে সময়ে সুনন্দার
দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।
কয়েকদিন যেতেই সুনন্দা একটা সুখবর পায়। মধ্যমগ্রামে থাকাকালে সে
ওখানকার স্থানীয় এনজিওতে ক্যাশিয়ার পদে আবেদন করেছিল। শ্বশুর
বাড়িতে থাকাকালে সে ওখানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছিল। তার
সুনন্দাকে ওই পদে নিয়োগপত্র মধ্যমগ্রামের ঠিকানায় পাঠানোর খবরটা
রমেশ ফোন করে সুনন্দাকে জানালে যেমনটা সে খুশি হয়। অন্যদিক, আবার
দু:চিন্তায়ও পড়ে। মধ্যমগ্রামে কি তাকে আবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে! সুনন্দা
সিদ্ধান্ত নেয় বনগাঁও লোকাল ট্রেনে গোবরডাঙ্গা থেকে মধ্যগ্রামে গিয়ে অফিস
করবে। সুনন্দার চাকরীর খবর পরেশের কানে যেতে দেরি হয় না। এবার
ভাবে, সুনন্দাকে দূরে রাখার কোন অর্থ হয় না।
পরেশ সুনন্দার মায়ের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে পরেশ বুঝতে পারে অবস্থা
বেগতিক। এতদিন সুনন্দাকে তুচ্ছতাছিল্য করে আসাটা সঠিক হয়নি, পরেশ
ভাবে। সে মনে করে মেয়েদেরকে বাগে আনতে হলে আদর, সোহাগ আর
একটু ভালবাসার ভান করাই যথেষ্ট। অথচ পর মুহূর্তে পরেশ ভাবে, এ কথাটাও
কিন্তু সঠিক নয়, সে তার বাল্যজীবনের সাথী সুপ্রিয়াকে কি কম ভালবেসেছিল,
মনপ্রাণ দিয়ে সে তাকে পেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে সুপ্রিয়ার কাছ থেকে কী
পেয়েছে। যদি সে অগ্নি সাক্ষীকরা বউ সুনন্দাকে সত্যিকারের ভালবাসতো তবে
তাদের জীবন সুখের অর্থ হতো। পরেশ মনে করে, সত্যিকার অর্থে সুপ্রিয়ার
চেয়ে সুনন্দার সঙ্গে সান্নিধ্যে তার কেটেছিল। পরেশ বোম্বে থাকাকালে তার
ছোট ভাই রমেশের বিয়ে হয়, সে সময় ওদের বাবা মা বেঁচে ছিল। সুনন্দা
তখন শ্বশুরবাড়ি মধ্যমগ্রামেই থাকত। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে সুনন্দাও দেওর
রমেশের জন্য কনে দেখতে গঙ্গার ওপাড়ের উত্তর পাড়ায় গিয়েছিল। মধ্যমগ্রাম
স্টেশনের পশ্চিম দিকের শহরে ঢুকবার মোড়ের জনবহুল এলাকার রমেশের
স্টেশনারী দোকানটা ছিল পয়মন্ত। বিয়ের পর দোকানটা আরো রমরমা হয়ে
উঠল। সুনন্দা মনে হল রমেশের বউ রমা সত্যি সত্যি সংসার করার মত মেয়ে,
অন্যদিকে রমেশও সংসারী ছেলে। ওদের বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যে রমার
কোলজুড়ে একটা ছেলে জš§াল।
সুনন্দার অফিসের কাছেই রমেশের স্টেশনারী সপ। গোবরডাঙ্গা ফিরবার পথে
সময় পেলে সুনন্দা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই রমেশের সঙ্গে কথা বলত। তখনো
দাদার সঙ্গে বৌদির ডিভোর্স হয়নি। সুনন্দা তার একমাত্র দেওর রমেশকে
বলে আসছিল সে পরেশকে ডিভোর্সের নোটিশ দেওয়ার কথা ভাবছে, শুধুমাত্র
শয্যাশায়ী শ্বশুরশাশুড়ির কথা ভেবে দিতে পারছি না। তাওতো মাঝেমধ্যে
তাদেরকে দেখতে যেতে পারছে, রমেশের বউ রমা তাদের যে ধরনের
সেবাযত্ন করছে তা দেখে রমার উপর সুনন্দা খুবই খুশি। পরেশ বাড়ি ফিরে
আসায় রমেশ ভেবেছিল, এবার হয়তো দাদা বউদির সঙ্গে ঘরসংসার করবে।
কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই দাদার স্বরূপ বুঝতে পারল রমেশ। বাবা
মা মারা যাওয়ায় তখন তাদের মাথার উপরে কোন অভিভাবক নেই। পরেশ
ও সুনন্দার দুহাত পুনরায় এক করে কে আর দেবে? তবুও রমেশ সুনন্দাকে
একদিন বলেছিল, ‘দাদা ফিরে আসায় তুমি সন্তুষ্ঠ হওনি বৌদি?’ সুনন্দা ভেবে
পেয়েছিল সে দেওরের কথার কী জবাব দেবে! তবুও অনেক সময় ধরে সুনন্দা
বলে, ‘তোমার দাদা কি আজ আর সেই দাদা আছে!’
চাকরি পাওয়ার পর পরেশের কাছে সুনন্দার দাম বেড়ে যায়। সে একদিন
অফিসে সুনন্দার সঙ্গে দেখা করে তার কাছে টাকা চাইলে সুনন্দা বুঝতে পারে
সে তার জীবন থেকে সব কিছু হারিয়েছে। তার হাবভাব দেখে বুঝতে কষ্ট হয়
না সুনন্দার যে তার স্বামী মাদকাশক্ত। ছন্নছাড়া মাদকাশক্ত স্বামীর হাত থেকে
বাঁচার জন্য তার বিবাহবিচ্ছেদের কথা তার কাছে সোজাসুজি পাড়া উচিত,
যদি সে বিবাহবিচ্ছেদে রাজি না হয় তবে তাকেই তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা
রজু করতে হবে। সমঝোতার মাধ্যমে ডিভোর্স পেপারে পরেশ সই করলে,
সমস্যার সমাধান হবে। সুনন্দা এ বিষয়ে আলোচনার জন্য রমেশের সঙ্গে
দোকানে দেখা করে। সুনন্দা তার দেওর রমেশকে বলে, ‘তোমার দাদা যদি
সেচ্ছায় ডিভোর্স পেপারে সই করে তবে, আমি মাসে মাসে তাকে একটা হাত
খরচ দেব, আর সেই টাকাটা তোমার হাতে দিয়ে যাব।’
রমেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে দাদাকে ডিফোর্স পেপারে সই করাতে রাজি করায়।
পরেশের সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর সুনন্দা মনে এক ধরনের স্বস্তির আভাস ফুটে
উঠলেও মুহূর্তের মধ্যে সুনন্দার মুখে আষাঢ়ের আকাশের ঘনঘটা।
পরেশের সঙ্গে সুনন্দার ডিভোর্স এর পর কয়েক বছর কেটে গেছে। তার
নিজের বাবা গত বছর মারা গেছেন বার্ধক্য জনিত কারণে। সুনন্দা বাপের বাড়ি
গোবরডাঙ্গায় তার নিজের মা, ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের ভাই এবং তাদের
একমাত্র ছেলে মৃš§য়কে সাথে মিলেমিশে বসবাস করছে।
সুনন্দা মনে মনে ভাবে, সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল।
ঘটনাক্লমে সেই পোড়া ঘরে আজ রাতে একবারের জন্য হলেও তার কি যাওয়া
ঠিক হবে! শেষ পর্যন্ত রমেশের সঙ্গে সুনন্দা পা বাড়ায়।