পো লিশ-ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক, জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট
অফ ডার্কনেস’ দুর্নীতিগ্রস্ত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার
প্রতিফলন ও অন্ধকার অধ্যায়গুলোকে গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে
উন্মোচিত করা এক বহুমাত্রিক সাহিত্যকর্ম। কনরাডের নিজ
দর্শনের ছোঁয়ায় রচিত তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত মাত্র ১০০ পৃষ্ঠার
উপন্যাসিকাটি ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয় যেখানে মানবিক
অভিজ্ঞতা, সভ্যতা এবং অন্ধকার অন্বেষণে এক কাল্পনিক যাত্রার
ঘটনাগুলো খুব দ্রুত প্রবাহিত হতে থাকে। উপন্যাসিকার মূল
চরিত্র চার্লস মার্লো, যিনি কুর্টজ নামে একজন রহস্যময় বাণিজ্যিক
প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ এর উদ্দেশ্যে ছোট জলযানে কঙ্গো নদী
অভিমুখে যাত্রা করে আফ্রিকার এক অজানা অঞ্চলে প্রবেশ করেন।
প্রাথমিক পরিচিতিতে ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’-কে কেবল ভ্রমণকাহিনী মনে করলে
বিরাট ভুলের সম্মুখীন হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে নাবিক মার্লোর
আফ্রিকার গহীনে এই যাত্রা শুধুমাত্র শারীরিক নয়, বরং এক জরুরি নৈতিক
ও আত্মিক অনুসন্ধান,প্রবল প্রতিক্রিয়া। উপন্যাসিকাটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে
পুন:প্রকাশিত ও পুনঃমুদ্রিত হয় এবং বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য অনূদিত হয়েছে।
এটি ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার ১৯৭৯ সালের চলচ্চিত্র ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাও’
এর অনুপ্রেরণা প্রদান করে। ১৯৯৮ সালে মডার্ন লাইব্রেরি ২০ শতকের
ইংরেজি ভাষার সেরা ১০০টি উপন্যাসের তালিকায় ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ কে
৬৭ তম স্থান দেয়।
শুরুতেই পাঠকদের চমকপ্রদ তথ্যটি জানিয়ে রাখা ভালো যে, ঔপনিবেশিক
প্রেক্ষাপটের এই রচনাটি জোসেফ কনরাডের জীবদ্দশায় তেমন উল্লেখযোগ্য
সাফল্যের মুখ দেখে নি। ১৯০২ সালে ‘ইয়ুথ’ এবং ‘দ্য এন্ড অফ দ্য টিথার’
উপন্যাস দুটির সাথে একক খণ্ড হিসাবে প্রকাশের পর সমালোচকদের
কাছে ‘নূন্যতম’ মন্তব্য পায় ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’। এফ. আর. লেভিস হার্ট
অফ ডার্কনেসকে একটি ‘ছোট কাজ’ হিসাবে উল্লেখ করে এর ‘অবর্ণনীয়
এবং বোধগম্য রহস্যে বিশেষণের জোর’ দেয়ার সমালোচনা করেন। এমনকি
কনরাড নিজেও এটিকে তাঁর বিশেষ উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম বিবেচনা করেননি।
তবে ১৯৬০-এর দশকে উপন্যাসিকাটি বিভিন্ন কলেজ এবং হাই স্কুলে ইংরেজি
কোর্সের আদর্শ এক অ্যাসাইনমেন্টের বিষয়বস্তু ছিল।
হার্ট অফ ডার্কনেস
‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ সবচেয়ে কঠোর সমালোচনা শোনে উত্তর ঔপনিবেশিক
গবেষকদের কাছে, বিশেষ করে প্রখ্যাত নাইজেরিয়ান ঔপন্যাসিক চিনুয়া
আচেবে ১৯৭৫ সালে তাঁর ‘অ্যান ইমেজ অফ আফ্রিকাঃ রেসিজম ইন কনরাডের
হার্ট অফ ডার্কনেস’ শিরোনামের প্রকাশ্য বক্তৃতায় এই উপন্যাসিকাকে
‘এক আপত্তিকর এবং নিন্দনীয় বই’ হিসাবে উল্লেখ করেন কেননা এতে
আফ্রিকানদের অমানবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।আচেবে’র যুক্তিতে
বইটি প্রকাশের সময় কনরাড কঙ্গো নদী অববাহিকায় বসবাসকারী,
ফ্যাং সম্প্রদায়ের শৈল্পিক কৃতিত্বকে উপেক্ষা করেছেন। তার মতে,বইটি
আফ্রিকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাবমূর্তি প্রচার করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে
যা মানব জাতির একটি অংশকে অবজ্ঞা করে। আচেবে এজন্য ‘হার্ট অফ
ডার্কনেস’-কে ‘দুর্দান্ত সাহিত্যকর্ম’ মানতে নারাজ।
সমালোচনা যাই হোক, ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ মূলত আফ্রিকার দ্বৈত প্রকৃ
তির চিত্রায়ণে জোসেফ কনরাডের সফল এক ক্যানভাস। এতে একদিকে
তিনি আফ্রিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্রকে তুলে ধরেছেন; অন্যদিকে,
ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা সেই সৌন্দর্যের নিপীড়নের চিত্রও পর্যায়ক্রমে
উপস্থাপন করেছেন। কঙ্গোর মাটি ও মানুষের শোষণ, নিপীড়নের প্রকাশ
ঘটিয়ে লেখক দেখাতে চেয়েছেন সভ্যতার মুখোশের আড়ালে ‘সত্যিকার
অন্ধকার’ ঠিক কীভাবে লুকিয়ে থাকে।
কুর্টজের চরিত্রের মাধ্যমে কনরাড দাসপ্রথা ও মানবিক শোষণের চিত্র তুলে
ধরেছেন। উপন্যাসের প্রথম দিকটায় কুর্টজের আদর্শবাদী ভাবনা এবং পরে
পতনের গল্প প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিকতার ভ্রান্তি ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক। কুর্টজ
যখন আফ্রিকার অন্ধকার অঞ্চলে প্রবেশ করেন,তখন তিনি সভ্যতার সমস্ত
নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেন। তার মৃত্যু ও শেষ উক্তি, ‘ঞযব যড়ৎৎড়ৎ! ঞযব
যড়ৎৎড়ৎ!’ (ভয়ঙ্কর! ভয়ঙ্কর!) মানবিকতার অবক্ষয় ও শোষণের অন্ধকার
দিককে নির্দেশ করে।
‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ এর কাহিনী বর্ণনায় কনরাড অত্যন্ত শৈল্পিক ও নিগূঢ়
ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন যা পাঠককে ভিন্ন জগতে পৌঁছে দেয়। কনরাডের
লেখায় ভাষার ব্যঞ্জনা এবং প্রতীকী উপস্থাপন বেশ শক্তিশালী। তিনি আফ্রিকার
বাসিন্দাদের প্রায়শই অবজেক্ট (বস্তুগত) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন,
যা ঔপনিবেশিকতার নিখুঁত দৃষ্টান্ত। আফ্রিকান জনগণের প্রতি উপেক্ষিত
হার্ট অফ ডার্কনেস
মানবিকতা ও তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার প্রতি প্রদর্শিত অশ্রদ্ধা কনরাডের
লেখায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কনরাডের এই উপস্থাপনা মনে করিয়ে দেয় যে,
ঔপনিবেশিক আমলে স্থানীয়দের অস্তিত্ব কতটা বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল।
তার রচনাশৈলি পাঠককে সরেজমিনে উপস্থিত থেকে ঘটনার আদ্যোপান্ত
বিশ্লেষণের সুযোগ করে দেয়। স্রষ্টার চিত্রায়ণ উপন্যাসিকার প্রতিটি দৃশ্যে
এক বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করে আর পাঠক সুযোগ পান এক অজানা এবং
রহস্যময় পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করার। কনরাডের ব্যবহার করা প্রতীকি শব্দ,
যেমন ‘অন্ধকার’ ও ‘আলো’ মানব জীবনের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে।
অন্যদিকে, ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও
গুরুত্বপূর্ণ। কনরাড দেখিয়েছেন সভ্যতার মুখোশের আড়ালে মানব মনের
অজানা প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি কীভাবে সরব থাকে। মার্লো কুর্টজের সঙ্গে সাক্ষাৎ
করার পর বুঝতে পারেন সভ্যতার সীমানা অতিক্রম করে গেলে কীভাবে
একজন মানুষ নিজের ভেতরের অন্ধকারকে আবিষ্কার করতে পারে। কুর্টজের
মৃত্যুর মুহূর্তে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বাক্য ‘আমি একটি জিনিস
দেখেছি, যা আপনারা জানেন না।’ মানব মনের অন্ধকার দিকের প্রতি সুষ্পষ্ট
ইঙ্গিত। আফ্রিকার পথে মার্লোর যাত্রার মাধ্যমে কনরাড আমাদের নৈতিক
সংকট ও মানবিকতার দ্বন্দ্বের দিকে ইশারা করেন যা সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
থেকে বেরিয়ে আসার একটি প্রচেষ্টাও বটে। এছাড়া, ঔপনিবেশিকতার
বিপরীতে উপন্যাসিকায় এক প্রকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠতেও দেখা
যায়। মার্লো এবং কুর্টজের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মানবিক অভিজ্ঞতার এক জটিল চিত্র।
কনরাডের দৃষ্টিতে সভ্যতার অগ্রগতি কখনও কখনও মানুষকে অন্ধকারের
পথে ধাবিত করে যা আমাদের নৈতিক চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জোসেফ কনরাডের উপন্যাসিকাটি চরিত্র গঠন, চরিত্রগুলোর মাঝে
কথোপকথন ও পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের এক চমৎকার উদাহরণ।
মার্লো এবং কুর্টজের সম্পর্কটি উপন্যাসের তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
মার্লো যখন কুর্টজের কথা প্রথম শোনেন, তখন তাঁর প্রতি এক ধরনের
মুগ্ধতা কাজ করে। পরবর্তীতে কুর্টজের প্রকৃত চেহারা আবিষ্কার করার পরে
সেই মুগ্ধতা দ্রুত বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হয়। উপন্যাসিকায় কুর্টজের
মৃত্যু মার্লোর জন্য এক বিপর্যয়কর অভিজ্ঞতা,যা তাকে জীবন ও মৃত্যুর নিয়ে
প্রগাঢ় চিন্তায় মগ্ন হতে বাধ্য করে।
হার্ট অফ ডার্কনেস
‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ পাঠকের জন্য ঠিক কতটা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হবে-এ প্রশ্নের
জবাবে বলতে দ্বিধা নেই যে, খুব একটা ‘আনন্দময় পঠণ’ হবে না। এর মূল
কারণ হচ্ছে উপন্যাসে বর্ণিত ঔপনিবেশিককতার নানা নেতিবাচক প্রভাবও
কালো অধ্যায় এবং মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
সংবেদনশীল পাঠককে অস্থির করে তুলবে। উপন্যাসে উপস্থাপিত অধিকাংশ
দর্শন কিংবা ন্যায়,অন্যায় যাচাই-বাছাই এর ক্ষেত্রে পাঠক সুনির্দিষ্ট কোন
উত্তর পাবেন না। এই ধারণাগুলি কতটা সঠিক কিংবা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য
তার প্রকৃত অনুসন্ধানে পাঠককে নিজ অনুমান কিংবা নিজ মত অনুসরণ করে
খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রসঙ্গে জোসেফ কনরাড যেমন নিজেই বলেছেন
পাঠকের এ বিষয়ে এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ: ‘সৃজনশীল কাজের
একমাত্র বৈধ ভিত্তি হল সমস্ত অপ্রতিরোধ্য শত্রুতার সাহসী স্বীকৃতি যা
আমাদের জীবনকে এত রহস্যময়, এত বোঝাময়, এত আকর্ষণীয়, এত
বিপজ্জনক কিংবা এত আশায় পূর্ণ করে তোলে।’
‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ নির্দিষ্ট কোন স্থান, কাল বা পাত্র অনুসারে রচিত কেবল
কল্পকাহিনী কিংবা জীবনী নয় বরং মানব অভিজ্ঞতার নানা দিকের সমন্বয়ে
এক প্রগাঢ় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। প্রায় ১২৫ বছর আগের এই সাহিত্যকর্মটি
আজও ঔপনিবেশিকতার মতো শাসক-শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, জাতিগত
দ্বন্দ্ব ও বৈষম্যসহ সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে পাঠক, সমালোচকদের সচেতন
করে তোলে, মানব মনের অজানা গতি-প্রকৃতি ও মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণেথ
স্বরূপ বিশ্লেষণ করে। উপন্যাসটি পাঠককে ভাবঔেত বাধ্য করে, সভ্যতা
কি আসলেই ‘মিথ্যা’ প্রতীক,অন্ধকারের মুখোশ? সভ্যতা মূলত কতটা সভ্য?
আর এভাবেই, ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ ধ্রুপদী সাহিত্যের এক কালোত্তীর্ণ অংশ
হয়ে আছে।