Description
কমনওয়েলথ পুরস্কারপ্রাপ্ত ছোটগল্প খণ্ড-২
ভৌতিক বিয়ে
মূল। আন্দ্রে মুলানি
অনুবাদ। সুরাইয়া ফারজানা হাসান
আমার স্বামীর মৃত্যুর ছয় বছর পরে আমাদের প্রথম মিলন হয়। এখন সে প্রায়ই রাতের আঁধারে আমার কাছে চলে আসে। কবিতার ভাষায় প্রেম নিবেদন করে:
‘আহা, এই রাতের শোভা;
জেসমিনের সুরভী;
আর আমার প্রেয়সীর মুক্ত, দীঘল কেশগুচ্ছ।’
আমি অবাক হই। এই ছয়টি বছরে একটি প্রেতাত্মা কীভাবে আমুল বদলে যায়। একজন মুখচোরা ভদ্রলোক কীভাবে এমন রোমান্টিক প্রেমিক পুরুষে পরিণত হয়। শুনেছি আমার স্বামী চোংলিন বেশ ভদ্রলোক ছিলো।
তবে আমার কাছে সে এখন শুধুই কোমলহৃদয়ের এক প্রেমিক। মৃত্যু তার জীবন কেড়ে নিয়ে, তাকে চিরতরের জন্য চিরসবুজ করে রেখেছে। তার ওই সুন্দর মুখখানিতে আর কখনো বয়সের বলিরেখা পরবে না। সে এলে আমি তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করি না। কেননা সেতো এখন এসবের উর্দ্ধে। সে শুধুমাত্র আমাকে নিয়ে কবিতার বাসর সাজায়।
আমাদের বিয়ের রাতে সে আমার কাছে আসেনি। এর প্রায় তিনমাস পর, আমার ঘরে তার আগমন ঘটে। হয়তো সে লজ্জায় ম্রিয়মান ছিলো; অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক সে তার স্ত্রীর কাছে আসতে পারেনি। আর যেহেতু আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করি না; তাই জানিও না- আমাদের এধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে এমনটাই স্বাভাবিক কিনা। সম্ভবত এই সাংহাইয়েই অনেক নারী আছেন, যাদের রাতে মৃত স্বামীর সাথে মিলন হয়। তবে, আমিই বোধহয় একমাত্র ইংরেজ নারী।
আমার মৃত স্বামী চোংলিন সম্পর্কে ধারণা আমি তার ভাই গাও বোহাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছি। সেই আমাদের এই ভৌতিক বিয়ের আয়োজক। বোহাই যখন তার ভাই সম্পর্কে বলে, সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। তার মুখখানা অতি কোমল হয়ে উঠে। আমাদের দুজনের দৈনন্দিন ব্যবসায়িক আলাপ আলোচনার সময় যে গাম্ভীর্য্য ভাব লেগে থাকে- তা নিমেষে যেন উধাও হয়ে যায়।
বোহাই হয়তো দেখলো- একটি নদীতে রেশম বোঝাই নৌকা পার হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বলবে, ‘আহা, আমার ভাইটা ওই নদীতে প্রায়ই মাছ ধরতে যেত। ও বলতো, ওখানকার পানি নাকি খুব ভালো, খুবই বিশুদ্ধ।’ অথবা, হয়তো কোন এক ব্যবসায়ী আমাদের পাঠানো মালপত্র সম্পর্কে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে; সে বলবে- ‘চোংলিন এই লোকটাকে এক্কেবারেই দেখতে পারতো না। ও বলতো- ব্যাটা একটা আস্ত পেটুক- মুখের খাবারটা পুরো গলাধঃকরণ না করেই আরো কিছু খাবার জন্য মুখটা হা করে।’
পুরাতন বাড়ির সারেঙ্গ
ও বৃষ্টিভেজা রাতের পিশাচ
মূল। মাইকেল মেন্দিস
রূপান্তর। সুরাইয়া ফারজানা হাসান
অনেক অনেক দিন পর বৃষ্টি নামায়, সময়টা দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে বিজয়ের কাছে। বৃষ্টির নবধারা জলে পৃথিবীটা এবার ধুয়ে নেয়ে ওঠবে। ধুলার ধরনী পাবে সজীব প্রাণের ছোঁয়া। এতদিনের বাড়াবাড়ি রকমের ধুলার উড়াউড়ি বন্ধ হলো তবে এবার। তাঁর মনে স্বস্তি ফিরে এলো- শুধু ধুলা কেন; কোন কিছুই আর বাতাসে উড়বে না; বাও কুড়ুনী ঘুর্ণীর ভেতর পাঁক খাবে না।
যেহেতু, বৃষ্টিটা বহুদিন পর তৃষিত, উষর ভূমিতে নেমে এসেছে- বিজয়ের কাছে মনে হল এই বারি পতন বড় ধীর লয়ে চলছে। এরই মধ্যে বিজয় বাতাসে সোঁদা গন্ধের উপস্থিতি টের পেয়েছে। গন্ধটা তার কাছে বড় নষ্টালজিক। কারণ এই গন্ধ তাঁকে কৈশরের খেলার সাথি, এক বালিকার কথা মনে করিয়ে দেয়। মেয়েটি প্রায়ই তাকে জিজ্ঞেস করতো, ‘বৃষ্টির পরে ধুলার এই সোঁদা গন্ধটা কি তোমার ভালো লাগে?’ সে বলতো, ‘হ্যাঁ।’
আর এজন্যই সোঁদা গন্ধের জন্য তাঁর প্রাণ আকুল হয়। বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ার পরই যখন বাতাসে পরিবর্তনটা আসে, বুক ভরে সে সজীব নিঃশ্বাস নেয়। কী একটা আশায় যেন বুক ভরে যায়; আর মনটা হঠাৎ করেই ভালো হয়ে যায়। গত কয়েক দশক ধরে, এরকম ধারাই হয়ে আসছে। তার বয়স এখন ষাট ছুঁতে চলেছে। এমুহূর্তে সে একটা আরাম কেদারায় বসে আছে। এখনও, সেই ষোড়শ বর্ষে পা দেবার বহু বছর পর, তার মনে হচ্ছে- বৃষ্টির পরবর্তী সোঁদা গন্ধে এক ধরনের নিষ্পাপ ভাব আছে; যা আশা জাগায়। হতে পারে আজ থেকে বহু বছর পূর্বে, সেই কিশোরও ধুলোর মাঝে বৃষ্টি ফোটার গন্ধে এক ধরনের আশা খুঁজে পেত- যে স্মৃতিটা আজো তাকে সেই গন্ধের সাথে একাকার করে দিচ্ছে। যদিও সেই মেয়েটির অস্তিত্ব আর নেই তার জীবনে। তা মেয়েটি, যেখানেই থাকুক না কেন? ভালো থাকুক। বিজয় তাঁর কম্পিত প্রায় প্রাণহীন শুকনো আঙুল শুষ্ক ঠোঁটের ওপর রাখলো। সেখানে কিছু শুকনো, মরা চামড়া লেগে আছে। সে ওগুলো একটু খুঁটলো। এই ষাটের কাছাকাছি বয়সে, সে বেশ পরিণত হলেও, অপরিণত বয়সের কিছু অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে। একজন বৃদ্ধ ভাঙ্গারী যেমন- মনের ভুলে একগাদা ভাঙ্গা চোরা বাসন কোসন কিনে ফেলে ব্যবসায়ের জন্য।
Reviews
There are no reviews yet.