Sale!

নিউইয়র্ক থেকে দেখা জুলাই বিপ্লব

Original price was: ৳ 400.00.Current price is: ৳ 280.00.

Description

নিউইয়র্ক থেকে দেখা জুলাই বিপ্লব
 

নিউইয়র্ক থেকে দেখা জুলাই বিপ্লব

আন্দোলনের ডায়েরি

আজকের এই সময়টায় এসে যে কেউ বলবেন যে একাত্তরের যুদ্ধের অনেক বৈশিষ্ট্যের ভেতর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দুটি বিষয় এক স্বতঃস্ফূর্ততা, দুই দুঃসাহসিকতা। এই দুটি গুণই দেখতে পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যারা গড়ে তুলেছিলেন, সেই তরুণদের ভেতরে। তরুণরা দুঃসাহসী হয়, হতে পারে, তাদের ভেতর স্বতঃস্ফূর্ততাও থাকে। কিন্তু যে ১০ জন তরুণ একত্র হয়েছিলেন বেতার কেন্দ্রটি গড়ে তুলতে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা ও দুঃসাহসের উৎস ছিল অভিন্ন, সেটি হলো দেশপ্রেম। সঙ্গে ছিল বিপ্লবী চেতনা।
একাত্তরে ২৬ মার্চের বিধ্বস্ত ও ভয়ংকর সকালবেলায় তারা ভাবছিলেন কী করা যায়। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে ব্যবহার করে স্বাধীনতার কথা প্রচার করা যায় কিনা এই চিন্তা তাদের মাথায় এসেছিল, কিন্তু কেন্দ্রটি শহরের একেবারে ভেতরে। পাকিস্তানি হানাদাররা সহজেই আক্রমণ করতে পারবে এই বিবেচনা থেকে শহরের বাইরে কালুরঘাটে গিয়ে সেখানকার ট্রান্সমিটারটি ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করেন। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ংকর দুঃসাহসিক। কী ঘটতে যাচ্ছে, তা জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরুই হয়নি। কোথাও বিদ্রোহের কোনো ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা ছিল না। সবটাই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্তিকর। এরই ভেতর তারা নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বেতার কেন্দ্র চালু করবেন। অন্য কয়েকজন এসে যোগ দিয়েছিলেন, কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল দশ। তবে তারা যে তখন রাষ্ট্রদ্রোহের কাজ করতে যাচ্ছেন, সেটি তারা জানতেন। কী প্রচার করবেন সে বিষয়ে মোটেই পরিষ্কার ছিলেন না তারা। সবটিই ছিল অগোছালো। আসলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা ব্যাপারটিই ছিল অত্যন্ত অগোছালো। পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না, প্রস্তুতিও ছিল না।
জুনের ছয় তারিখে হঠাৎ করেই আমার স্বামী রানা একটু অসুস্থ হয়ে যায়। তলপেটে ব্যথা। কেন ব্যথা জানতে চাইলে বলে, সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। সেদিন আর রানা কাজে গেল না। বাসায় শুয়ে-বসে টিভি দেখছে। অফিস শেষে বাড়ি ফিরে আমিও পাশে বসে শরীরের খবর নেই আর টিভির দিকে চোখ রাখি। আমাদের চারজনের সংসার। মেয়েরা চাকরি সূত্রে দূরে থাকে, এখন দুজনের ঘর। তাই কাজের পর টিভিতে নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখেই আমাদের সময় কাটে। মাঝেমধ্যে দেশের খবর। আমেরিকার নির্বাচন, কোথায় কী হচ্ছে চোখ বুলিয়ে নেওয়া। যদিও বেশিরভাগ খবরই ফেসবুকের কল্যাণে জানা হয়ে যায় তবুও খবর দেখা আমাদের পুরনো অভ্যাস। দুজনে নিয়ম করে খবর দেখি। এই চ্যানেল সেই চ্যানেল ঘুরে হাসিনা সরকারের বন্ধনা আর উন্নয়নের গালগল্প ছাড়া সত্য খবরের খোঁজ করি। সত্য পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাসিনার উন্নয়নের ফিরিস্তি আর তার মা-বাবার গালগপ্প। শুনতে শুনতে আর মন চায় না। তাই আমরা মুভিতেই ফিরে যাই। মাঝেমধ্যে ইউটিউবারদের কথা শুনি। টেলিভিশন-পত্রিকা থেকে উনাদের খবরই সত্য মনে হয়। তাই আমার স্বামী রীতিমতো মনযোগ দিয়ে অনুসন্ধানি সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের কথা শোনে পরে আমাকে বুঝিয়ে বলে। কনক সারোয়ারের উপস্থাপনার টকশো নিয়মিত শোনে। পিনাকী ভট্টাচার্যের ভিডিও দেখে আর হো হো করে হেসে উঠে। সে হাসি ছড়িয়ে পড়ে আমার রান্নাঘর পর্যন্ত।
আমি বরের শরীরের অবস্থা চিন্তা করি, সে তো পিনাকী ভট্টাচার্যের ভিডিও দেখে হাসিখুশি আছে। ভাবি তাহলে কি সে সুস্থ? কাজে যোগদান করবে কবে? আমার মাথায় ঘর ভাড়া, গাড়ির বিলÑ এসব ঘোরপাক খায় যা আমার একার পক্ষে সামলানো সম্ভব না। সরাসরি বলা যায় না তবুও অফিস থেকে ফিরে কৌশলে জানতে চাই কবে কাজে যাবে?
বলে, আজকে গিয়েছিলাম, তবে তিন ঘণ্টা পর আর কাজ করতে পারিনি।
বলো কি!
হুম। চুপ করে থাকে।
কেমন লাগে তোমার?
বসতে গেলে তলপেটে ব্যথা সাথে বমি পায়।
ডাক্তার কী বলে?
কোনো উত্তর আসে না, আবাও চুপ করে থাকে। বেশি ঘাটালে মাইন্ড করবে তাই চুপচাপ ওর পাশে বসে টেলিভিশনের খবরে মনোনিবেশ করি।
জুনের পাঁচ তারিখ রানা বলছে একটা খবর কি শুনছো?
আমি বললাম না তো! কি খবর?
ঐ যে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানেরা কোটা পদ্ধতি বাতিলের বিরুদ্ধে যে আপিল করেছিল সেটার রায় তাদের পক্ষে এসেছে।
বললাম, তা তো জানাই ছিলো। শেখ হাসিনার মনোনীত আইনজীবী, বিচারপতি, বিচারালয়। কোনো রায়ই মানুষের চাওয়া পূরণ করবে না। গণভবন থেকে হাসিনা যা লেখে দেবে, আদালত সে মোতাবেক রায় পাঠ করবে ।
আমি তেমন একটা বিচলিত হই না। তবুও বলি, আইন, আদালত ও বিচার বিভাগ সবই তো ওদের।
আরে তা না, শিক্ষার্থীদের দাবীর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বলেছিল, সরকারি চাকরিতে আর কোনো কোটাই থাকবে না। তার কথা বলছি।
বললাম, বুঝেছি, জানি ।
আমার বর ধরেই নিয়েছে আমি বিষয়টি বুঝতে পারিনি। কাছে এসে টিভির সামনে বসলাম, হ্যাঁ তাদের পক্ষে রায় আসছে অর্থাৎ আগের মতো কোটা পদ্ধতি বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে আদালত।
এদিকে হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। যা, লোক দেখানো নাটক ছাড়া কিছুই না। আদালত এবং হাসিনা সরকার ছাত্রদের সাথে তামাশা করছে বলে পরিষ্কার বুঝতে পারছি। আমার মনে আছে, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনকারী ছাত্রদের শেখ হাসিনার সরকার পুলিশ দিয়ে কত নির্মমভাবে পিটিয়েছে, তাদের জেলে ঢুকিয়েছে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা কচি স্কুল শিক্ষার্থীদের শেখ হাসিনা পুলিশ ও ছাত্রলীগ লাগিয়ে দিয়ে পিটিয়ে থামিয়েছে। আজকের ভিপি নুর, রাশেদ সেই সময়ের তৈরি।
সেই ২০১৪ এর একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার বাবার মতো একনায়ক হয়ে উঠে। বিনা ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। এমন ঐতিহাসিক একতরফা নির্বাচন পৃথিবীর বুকে আর কোনো দেশে হয়েছে কিÑনা কেউ বলতে পারবে না। মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছে, দেশের গনতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। আওয়ামী লীগ তখন থেকেই মানুষের উপর চড়াও হয়েছে। কোনো ধরনের বিরোধী মতামত সে সহ্য করে না। রাস্তায় নেমে দাবিদাওয়ার কথা দূরে থাক, সামান্য ফেসবুক পোস্ট করলেই মানুষের নামে মামলা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিত। এর থেকে শিশুও বাদ যায়নি। সেই সাথে আওয়াজ তুলতে পারে এমন অনেক মানুষকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলেছে। অনেককেই নির্মমভাবে অত্যাচার করেছে। নেত্র নিউজ হাসিনার গুমঘরের খোঁজ নিয়ে ‘আয়না ঘর’ নামে ডকুমেন্টারি প্রচার করেছে। সাংবাদিক তাসনিম খলিলের অসাধারন কাজ। এর আগে অনুসন্ধানী সাংবাদিক সামিউল ইসলাম খান সামি হাসিনার নেতৃত্বে তার দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছে ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার ম্যান’ তৈরি করে। দুটি রিপোর্টই ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মানুষ সব জেনেও গুম হওয়ার ভয়ে আওয়াজ করেনি। কিছু কিছু ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন ন্যায্য দাবিÑদাওয়া নিয়ে মাঠে নামলেও তাঁদের হাসিনা সরকার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে জেল, জুলুম, অত্যাচার করে। সেই ভয় থেকে গণতন্ত্রকামী মানুষ এক সময় দমে যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার চেয়ারে রাজত্ব করেছেন শেখ হাসিনা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসেন তিনি। যদিও সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। পরে নিজেদের দলের প্রার্থীদেরই ‘ডামি প্রার্থী’ হিসেবে সংসদ সদস্য করে দেশ গড়ার শপথ নেন শেখ হাসিনা!
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বৈরাচারী মনোভাব হয়ে উঠেছিল তার। নিজের শাসনের বিরোধিতাকে দমন করেছেন কঠোর হাতে। রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অন্যান্য অপব্যবহার সবই তার শাসনে বেড়ে গিয়েছিল। কোটা সংস্কারের দাবিতে নামা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়া ও তাদের স্বাধীনতার অপশক্তি ‘রাজাকার’ হিসেবে সম্বোধন করে ব্যাপক ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি।
এর বাইরে সবশেষ তিনটি নির্বাচনে বিরোধী দলকে দমন করা ও এককভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন হাসিনা। সে লক্ষ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজের স্বপক্ষে রেখেছিলেন তিনি। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলেন না বাজার পরিস্থিতি। জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে শুরু করেছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
অন্যদিকে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অনেকেই দেশের টাকা আত্মসাত করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। দেশের টাকা লুট করে ব্যাংকগুলোকে খালি করে দিয়েছেন অনেকেই। আর এই সব কিছুর ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত দাবানলে রূপ নেয় জুলাই মাসের শেষ দিকে। এ সময় ছাত্রদের দমনে আওয়ামী লীগ ও নিজের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন তিনি। যাতে নিহত হয় হাজার হাজার তরুণ প্রাণ। এর পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে গণ আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে।
১৯৭৫ সালে নিজের পরিবারের সদস্যদের হারানোর পর ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সময় গণতন্ত্রপন্থি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসেন তিনি। ভারতের সাথে পানি-বণ্টন চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি উপজাতি বিদ্রোহীদের সাথে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য কৃতিত্ব অর্জন করেন। কিন্তু একই সময়ে সরকারের বহু দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড ও ভারতের খুব অধীন হওয়ার জন্য সমালোচিত হন। যার প্রভাব পড়ে ২০০১Ñ এর নির্বাচনে। ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতার চেয়ারে বসেন শেখ হাসিনা। লাগামহীন দুর্নীতি ও বিতর্কের মাঝে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক অবকাঠামো স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। তবে গেল বছরের মাঝামাঝিতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনের পর বেসামরিক চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবি নিয়ে অস্থিরতা শুরু হয়, পরে যা সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কেননা, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দমনে তিনি পুলিশকে ব্যবহার করেন। এ ছাড়াও করোনা মহামারির পর থেকেই বাংলাদেশে সবাইকে ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে লড়াই করতে হচ্ছিল। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীও দীর্ঘদিন ধরে আইনের গুরুতর অপব্যবহার ও নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল। যার কারণে ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর বাইরে শেখ হাসিনার দলীয় নেতাকর্মীরা দেশের সর্বত্র দমন-পীড়ন করছিল। সব মিলিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আক্রোশ জমাট বেঁধেছিল। সেই আক্রোশের কারণেই তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।
ক’দিন সুস্থ থাকলেও আমার বরের পেটের ব্যথা বাড়তে থাকে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বেশ বড়সড় হার্নিয়া পায় এবং দ্রুত অপারেশনের পরামর্শ দেয়। আমার বর আমাদের সবার কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখে। আবারও সে কাজে না যেয়ে ঘরে টিভি সেটের সামনে বসে থাকে। সারাক্ষণ ইউটিউবে ভিডিও দেখে। জুন মাস শেষে জুলাই শুরু হয়েছে। আমার ঘর ভাড়া দিতে হবে সে চিন্তায় ঘুম আসে না। মেয়েদের সাথে শেয়ার করি ওরাও তাদের বাবার রেস্ট করার কথা বলে। কি আর করা তাহলে রেস্টই সহি। আমাদের দুজনের প্রাইমারি ডাক্তার একই। তিন মাস অন্তর যাই। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি জানতে চান আমার হাজব্যান্ডের অপারেশন কেমন হয়েছে? ডাক্তার বললেন, উনার তো আমার সাথে যোগাযোগ করার কথা ছিল, করেননি কেন?
সব শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ডাক্তারকে বললাম আমি কিছুই জানি না। আমার বর হাসপাতাল, সার্জারি এ সবে ভয় পায় তাই সে ঘরে বসে চুপচাপ সব ব্যথা সহ্য করছে।
আমার নিজের উপর রাগ হয়। কেন বিষয়টা জানলাম না। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সংবাদ দেখতে দেখতে আমার ঘরের খবরই রাখা হয়নি। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। ডাক্তার আমাকে বলল, আজই হার্নিয়া সার্জনের সিরিয়াল নিতে। অন্য কাজ ছিল, সব কাজ ফেলে রেখে বাসায় ফিরে এলাম।
তাকে বললাম, তুমি আমার কাছ থেকে শরীরের অসুস্থতা লুকাও কেন? এখনি সার্জনকে ফোন দিয়ে সিরিয়াল নাও। সে সোজা বলে দেয় সার্জারি করাবে না। এই নিয়ে আমাদের তর্ক-বিতর্ক হয়। আমি জানি সে মেয়েদের কথা শুনবে। তাই মেয়ে দুটোকে সব জানালাম। মেয়েরা কল করে এক সপ্তাহে সার্জারির তারিখ পেয়ে গেল। জুলাই ১২ তারিখ লং আইল্যান্ড জুইস হাসপাতালে অপারেশন। আমার আম্মা, ভাইবোন সবাই জেনে ফোন দিতে লাগলো। এদিকে ভাইর স্ত্রী লাবনি জানালো, দেশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমার ছোট ভাইয়ের বউ ভীষণ রাজনৈতিক সচেতন। কোটা বাতিলের সেই আবেদন আবার চৌঠা জুলাই শুনানির জন্য আসলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। এতে ছাত্ররা একত্রিত হয়ে মাঠে নেমেছে। তারা এবার সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বাতিল না করে যৌক্তিক সংস্কার চায়।
টিভিতে দেখছি জুনে পাঁচ তারিখ রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হঠাৎ হইচই। জনা পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী কোটা বাতিলের দাবিতে দাঁড়িয়ে যান ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে। আলো-আঁধারি ক্যাম্পাসে নীরবতা ভেঙে শিক্ষার্থীরা সেøাগান দিতে থাকেন। ‘কোটা না মেধা? মেধা মেধা।’ হাজারো কণ্ঠে ধ্বনিত হতে শুরু হয় ‘মেধা মেধা’। সেই শুরু।
আমার পড়াশোনা, কর্মজীবন, বৈবাহিকজীবন, প্রেম-ভালোবাসা- সবই চট্টগ্রামকে ঘিরে। তাই আমরা নজর বীর চট্টলাকে ঘিরে।
এরপর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত মাঠে ছিলেন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভের রেশ ক্যাম্পাস থেকে পৌঁছে গিয়েছিল শহরেও। ঐক্যবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ করেছিলেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে এবার আন্দোলন শুরু হয় গত ৫ জুন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। ঢাকায় শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয় এবং শহীদ মিনারে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে।
এদিকে রানার শরীর জুড়ে ব্যথা বাড়তে থাকে। সে আবারও ডাক্তারে কাছে যেয়ে অপারেশন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ভালো হওয়া যায় কিনা জানতে চায়। ডাক্তার জানায়, হার্নিয়া বড় হয়ে গেছে এবং তা ইমিডিয়েট সার্জারি ছাড়া উপায় নেই। অপারেশনের তারিখ ঘনিয়ে আসলে ওর ভয় দেখে আমারও ভয় লাগতে থাকে। এরই মধ্যে পহেলা জুলাই থেকে কোটা বাতিল আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। নতুন সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-এর ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। টেলিভিশনে মিছিল দেখি। আমার ভীষণ ভয় লাগে। এবারের ছেলেমেয়েদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অন্যরকম লাগে। মনে হয় এবার তাঁরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না। আমরা অপারেশনের দিন গুনি আর টিভির সামনে বসে দেশের কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাপোর্ট করি। নিয়ম করে দেশের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করে আমাদের একাত্মতা জানাই। আমরা ভীষণ রকম হাসিনা অপছন্দ করি। সবসময় মানুষের পাশে থাকতে চাই। আমি নিয়মিত স্যোশাল মিডিয়ায় আন্দোলনের পক্ষে সাপোর্ট করে লিখে চলেছি। প্রতিদিনই আপডেট রাখছি আর লিখছি।
কোটা নিয়ে যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে ২০১৮-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। ১৯৭২ সাল থেকে চালু হওয়া কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। লাগাতার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট বাতিলকৃত কোটা পুনরায় বহাল করে। যার ফলে কোটা নিয়ে আরও একবার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
কোটাভিত্তিক পদ কমানো, শূন্য পদে মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণের দাবিতে রাস্তায় নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য, ১০ শতাংশ নারীদের জন্য, ১০ শতাংশ পিছিয়ে থাকা জেলার মানুষদের জন্য, পাঁচ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য এবং এক শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা ছিল। এতটা ভয়ানক পরিস্থিতি হয়তো সৃষ্টি হত না, যদিনা শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের বিক্ষোভ উপেক্ষা করে ২০২৪Ñ এর ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা ব্যবস্থা বহালই থাকবে বলে ঘোষণা না দিতেন। এই তিনিই ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে মহান সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা করেন, সেই একই মানুষ ২০২৪ এসে নিজের কথাই উল্টে দেন।

রওশন হক
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

Reviews

There are no reviews yet.

Be the first to review “নিউইয়র্ক থেকে দেখা জুলাই বিপ্লব”

Your email address will not be published. Required fields are marked *