Description
বিবিসি-ন্যাশনাল-অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত-ছোটগল্প
ভূমিকা
কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সেই লেখালেখি শুরু, জাতীয় পর্যায়ের পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি থেকে এক পর্যায়ে নব্বই দশকের শুরুতে সাংবাদিকতার জগতে বিচরণ। বছর পাঁচেক পর থেকে অদ্যাবধি ভিন্ন পেশা ব্যাংকিংয়ে। সাংবাদিকতায় মূলত ক্রীড়া বিষয়ক লেখালেখিতে সম্পৃক্ততার মাঝেও বইয়ের লেখক হিসেবে পাঠকদের সামনে নিজেকে হাজির করার সুপ্ত আকাক্সক্ষা ছিল মনের ভেতর। ‘কবে আপনার বই দেখব?’ সহকর্মী নাসরিন হোসেনের এ প্রশ্ন আমার সুপ্ত আকাক্সক্ষাকে উসকে দিয়েছে। বইয়ের লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশে আমার লেখা গভীর মনোযোগে পড়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়ে বরাবরই নাসরিন আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। পাশাপাশি গল্পকার সম্পাদক মুহাম্মদ মহিউদ্দিন দেখিয়েছেন মনের ভেতরের চিন্তাকে বাস্তবে আলোর মুখ দেখানোর পথ। আমাদের পুত্র মাসাফি মুস্তাফা হায়দার গল্পগুলো ডাউন লোড করে দিয়ে লেখার কাজটা সহজ করে দিয়েছে। আর ঘরের মানুষরা করোনাকালে আমার লেখালেখি সহ্য না করলে সময়সাপেক্ষ এ কাজটি করা সম্ভব হতো না।
অনুবাদ এবং বই হিসেবে প্রকাশের জন্য ‘বিবিসি ন্যাশনাল শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত গল্পগুলো’কে বেছে নেয়ার প্রেরণা দিয়েছেন গল্পকার সম্পাদক মুহাম্মদ মহিউদ্দিন। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব কাজের ফাঁকে ঘরে কিছুটা সময় বাড়তি থাকার সুযোগ পাওয়ায় কাজটা সহজ হয়েছে। বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় সেরা পুরস্কার পাওয়া গল্পগুলোর বাংলা অনুবাদ পাঠ, পাশাপাশি তাদের গল্পের বিষয়বস্তু, লেখা ও চিন্তা চেতনার ধরনের সাথে পরিচিত হয়ে পাঠকদের ভালো লাগবে আশা করি।
‘বিবিসি ন্যাশনাল শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড’ ব্রিটেনের একটি সাহিত্য পুরস্কার। ২০০৫ সালে ‘বিবিসি রেডিও ফোর’ ও ‘প্রসপেক্ট ম্যাগাজিন’-এর সহযোগিতায় এটি প্রবর্তন করে ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর সায়েন্স, টেকনোলোজি অ্যান্ড দ্য আর্ট ‘এনইএসটিএ’। একটি মাত্র ছোটগল্পের জন্য বিজয়ী পেয়ে থাকেন ১৫ হাজার পাউন্ড। প্রথমে এটি ‘ন্যাশনাল শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড’ নামেই চালু হয়। স্পন্সররা সম্পৃক্ত হওয়ায় বিবিসির নাম যুক্ত হয়। মূলত ব্রিটিশ লেখকদের জন্য এ পুরস্কারটি চালু হলেও ২০১২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের প্রাক্কালে কেবল ওই বছরের জন্য এটি বৈশ্বিক লেখকদের জন্য উš§ুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে বিবিসির গ্রহণযোগ্যতা থাকায় বিবিসি ন্যাশনাল শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত গল্পগুলোও পাঠক মহলে সমাদৃত হবে বলে আশা রাখি।
ইস্ট অব দ্যা ওয়েস্ট
অবশেষে বিয়োগ্রাড পৌঁছাতে ত্রিশ বছর লেগেছে আমার। কাঙ্খিত স্থানে আসতে পেরেছি তাই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর জন্য খারাপ লাগে না বরং ভালো লাগে এটা ভেবে যে, প্রতিটি ক্ষণের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে আমার ভালোবাসার শ্বাস-প্রশ্বাস। এখন আমি আমার কাজিনের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে, একহাতে ফুল অন্য হাতে চকোলেট বার নিয়ে দাঁড়িয়ে, মনে মনে সেই সাধারণ প্রশ্নটিরই মহড়া চলছে, যে প্রশ্নটি আমি করবো তাকে। একটু আগে এক সার্বিয়ান ড্রাইভার থুথু মেরেছে আমার গায়ে। শার্টের ওপরের ওই থুথু’র দাগ মুছতে কিছুটা সময় লেগেছে। এগারো .. .. থেকে সময় গণনা করছি আমি, মনে মনে বারে বারে আওড়াতে থাকি ‘ভেরা, তুমি কী আমাকে বিয়ে করবে?’
ভেরার সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৭০-এর গ্রীষ্মে, তখন আমার বয়স ছয়। আমার পরিবারের সাথে আমি থাকতাম বুলগারোস্কো সেলো গ্রামে, নদীর পাড়ে গ্রামটির অবস্থান। নদীর অপর পাড়ে সারবস্কোতে বসবাস ছিল ওদের। অনেক দিন আগে দুটি এলাকা ছিল একই গ্রামের অধীন। গ্রামের নাম ছিল স্টারো সেলো। বড় বড় যুদ্ধের পর বুলগেরিয়ার হাতছাড়া হয়ে যায় গ্রামটি। এলাকাটি চলে যায় সার্বদের দখলে। আর নদীটি হয়ে ওঠে দুটি গ্রামের মাঝে বিভাজক। নদীর পূর্ব পাশের বুলগারোস্কো সেলো পড়েছে বুলগেরিয়ায় আর পশ্চিম পাশের সারবস্কো গ্রামটি সার্বিয়ায়।
নিদারুণ দুর্দশায় নিপতিত দুই গ্রামের বাসিন্দাদের অবস্থা দেখে ওখানকার লোকজন দুই দেশের কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে প্রতি পাঁচ বছরে দুই গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য একটা পূনর্মিলনী আয়োজনের অনুমতি যোগাড় করে। এই পূনর্মিলনীর নাম ‘এসবর’। আনুষ্ঠানিক এ আয়োজনের উদ্দেশ্য আমরা যেন আমাদের শেকড়কে ভুলে না যাই। অবশ্য অনেকের জন্য এই পূনর্মিলনী হয়ে ওঠে ইচ্ছেমতো ঝলসানো মাংস খাওয়া আর স্থানীয় মদ ‘রাকিয়া’য় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার অপূর্ব সুযোগ হিসেবে। একেকজন খেতে খেতে অসুস্থ হবার পূর্ব পর্যন্ত খেতে থাকতো, এরপর তারা ‘রাকিয়া’ পানে মত্ত হতো একটু আগে গলা পর্যন্ত ঝলসানো মাংস খেয়ে অসুস্থ হবার কথা ভুলে গিয়ে। ১৯৭০-এর গ্রীষ্মে পূনর্মিলনী আয়োজনের ভেন্যু ছিল সারবস্কো। তার অর্থ আমাদের নদী পার হয়ে যোগ দিতে হয়েছিল ‘এসবর’এ।
যেভাবে আমরা নদী পার হলাম :
বেশ হৈইচই শোরগোল আর পানির ওপরে কুন্ডুলি পাকানো ধোঁয়া তুলে আমরা নদী পার হই। মিহালাকিও আসছেন তার নিজের নৌকায় চড়ে। বেশ বর্ণিল তার নৌকা। এটা আসলে নৌকা নয় এটা একটা মোটরযুক্ত ভেলা। মিহালাকি পুরোনো ‘মস্কভিস’-এর সিটে বসে আছেন। ‘মস্কভিস‘ হলো রাশিয়ার মোটর কার, যাতে ট্যাংকের ইঞ্জিন জুড়ে দেয়া হয়েছে। সিটটিকে তিনি পেরেক ঠুকে ভেলার পাটাতনের সাথে যুক্ত করে নিয়েছেন। আর উপরিভাগের আচ্ছাদন ছাগলের চামড়ায় মোড়ানো, পশম ছাঁটা, বাদামি রঙের ওপর সাদা কালো ছিটে ফোটা। মিহালাকি যেন বসে আছেন নিজের সিংহাসনে, ধীর স্থির দোর্দন্ড প্রতাপশালী ভাব নিয়ে। একটা পাইপ টানছেন ঠোঁটে আবলুস কাঠের মাউথপিস, মাথার পেছনে তার সাদা লম্বা চুলগুলো উড়ছে পতাকার মতো।
নদীর পাড়ে অপেক্ষমান আমাদের আত্মীয় স্বজনরা। আমার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, এক হাতে একটা ভেড়া তার অন্য পাশে কাঁধের ওপর আঙুরের রসে তৈরি পেট মোটা কাঁচের বোতল ভরা মদ ‘রাকিয়া’। তার জ্বলজ্বলে চোখ জোড়া নৌকার ওপর নিবদ্ধ। আবেগ উত্তেজনার আবেশে বারবার জিভের ছোঁয়ায় ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছেন। তার পাশে একটা কাঠের পিঁপা রাখা আছে। ভেতরে সাদা পনির। আমার চাচা পিঁপার ওপর বসে বুলগেরিয়ান মুদ্রা গুনছেন।
Reviews
There are no reviews yet.