Description

সা’দাত হাসান মান্টো’র শ্রেষ্ঠগল্প
সা’দাত হাসান মান্টো উর্দু সাহিত্যের অন্যতম সেরা গল্পকার। প্রায় দুই দশকের সাহিত্য জীবনে মান্টোর বিশটিরও বেশি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশ পেয়েছে। সা’দাত হাসান মান্টো ১১ মে ১৯১২ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লুধিয়ানা জেলার সামরালার পাপরুদি গ্রামে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কাশ্মীরি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান মান্টো তার পরিবার উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অমৃতসরে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং আইন পেশার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। তাঁর বাবা খাজা গোলাম হাসান স্থানীয় আদালতের দায়রা জজ ছিলেন। তাঁর মা, সরদার বেগম পাঠান বংশের এবং তিনি মান্টোর পিতার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। মূলত উর্দুতে লিখতেন মান্টো। তিনি ২২টি ছোটগল্পের সংকলন, উপন্যাস, ৫টি রেডিও নাটকের সিরিজ, তিনটি প্রবন্ধ সংকলণ এবং ব্যক্তিগত স্কেচের দুটি সংগ্রহের লেখক। তিনি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন এবং দেশ বিভাজনের গল্পগুলোর জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত। মান্টোকে ছয়বার অশ্লীল লেখা দায়ে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল; ব্রিটিশ ভারতে ১৯৪৭ সালের আগে তিনবার এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে তিনবার, কিন্তু কখনও দোষী সাব্যস্ত হননি। তিনি বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উর্দু লেখকদের একজন হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ১৮ জানুয়ারি ১৯৫৫ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে লাহোর, পাকিস্তানে মৃত্যুবরণ করেন।
খালি বোতল, খালি কৌটা
যে পুরুষরা অবিবাহিত তাদের খালি বোতল আর কৌটার প্রতি এত আকর্ষণ কেন থাকে এই ব্যাপারটি আমাকে এখনো অবাক করে? আমি ওই অবিবাহিত পুরুষদের সম্বন্ধে বলছি যাদের বিয়ে করার কোনো আগ্রহ নেই, ইচ্ছে নেই।
এই ধরনের পুরুষরা সাধারণত পাগলাটে আর অদ্ভুত আচরণের অধিকারী হয়ে থাকে। কিন্তু এটা বোধগম্য নয় তাদের খালি বোতল আর কৌটার প্রতি এত প্রেম কেন? পাখি আর জন্তু তারা পোষে এটা নাহয় বোঝা যায় যে নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য কিন্তু খালি বোতল আর কৌটা তাদের কী উপকার করে?
এই সব পাগলামি আর অদ্ভুত আচরণের কারণ খোঁজা খুব দুরূহ কোনো ব্যাপার নয় যেহেতু প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে এমন অসঙ্গতি ঘটতেই পারে। কিন্তু এটার মনস্তত্ত্বিক গভীরতায় যাওয়া একটু কঠিন ব্যাপার।
আমার একজন আত্মীয় আছেন, তার বয়স হবে প্রায় পঞ্চাশ বছর। তিনি কবুতর আর কুকুর পোষেণ। এটাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কিন্তু তিনি প্রত্যেক দিন বাজার থেকে দুধের সর কিনে নিয়ে আসেন। ওই সর দিয়ে উনি ঘি বানান এবং ওটা দিয়ে নিজের জন্য তরকারি রান্না করেন। উনি মনে করেন এই ভাবে খাঁটি ঘি তৈরি হয়। পানি খাওয়ার জন্য একটি আলাদা কলস আছে যার মুখ এক টুকরা মসলিন কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকে যেন কীটপতঙ্গ না ঢুকতে পারে কিন্তু বাতাসের প্রবাহ যেন থাকে। টয়লেট যাওয়ার সময় সব কাপড় নামিয়ে একটি ছোট তোয়ালে কোমরে পেঁচিয়ে নেন আর একটি কাঠের খড়ম পরে নেন। এখন কে তার সর থেকে ঘি বানানো, কলসের গলায় মসলিনের টুকরা পেঁচানো, কোমরে তোয়ালে পেঁচানো, কাঠের খড়ম পরা, এসব কর্মকাণ্ডের মনস্তত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে যাবে।
মজিল
ত্রিলোচন এই প্রথম… এই প্রথম চার বছরের মধ্যে রাতের বেলা আকাশ দেখছে। তার আবার কারণ হচ্ছে যে তার মন খুব খারাপ আর সে খোলা জায়গায়, মুক্ত বাতাসে কিছু চিন্তা করার জন্য আদভানি চেম্বারসের টেরেসে চলে এসেছে।
আকাশটি একেবারে পরিষ্কার, মেঘ শূন্য, একটি বিরাট ধূসর তাঁবুর মতো বোম্বে শহরকে ঢেকে রেখেছে। চোখ যত দূর যায় শুধু বাতি দেখা যায়। ত্রিলোচনের মনে হলো এই বাতিগুলো আকাশ থেকে ঝরে পড়া তারা আর অন্ধকারে দালান কোঠাগুলো গাছের মতো লাগছে এবং এই তারাগুলো ওই গাছগুলোতে এসে আটকে গেছে আর জোনাকির মতো ঝিলমিল করছে।
ত্রিলোচনের জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা, একটি নতুন অনুভূতি… রাতের বেলা খোলা আকাশের নিচে থাকা। তার মনে হলো সে আজ চার বছর ধরে নিজের ফ্ল্যাটে বন্দি এবং প্রকৃতির একটি বড় নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। এখন রাত তিনটা, নির্মল বাতাস বইছে। ত্রিলোচন ফ্যানের যান্ত্রিক বাতাসে অভ্যস্ত যেটা তার শরীরকে অলস করে দেয়। সকালে ঘুম থেকে উঠলে তার মনে হয় যেন সারা রাত তাকে পেটানো হয়েছে। এখন এই ভোরের নরম বাতাসের নির্যাস তার শরীর টেনে নিয়ে আনন্দে ভরে উঠছে। যখন সে এখানে এসেছিল তখন সে খুবই উত্তেজিত আর মানসিক চাপে ছিল। কিন্তু আধা ঘণ্টার মধ্যেই তার সব উত্তেজনা আর মানসিক চাপ কমে গিয়ে এখন সে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে।
কৃপাল কৌর আর তার পুরো পরিবার একটি মহল্লায় আটকে আছে যেটি বেশ কট্টর মুসলমানদের এলাকা। সেখানে কয়েকটি বাসায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, অনেক লোক মারাও গেছে। ত্রিলোচন গিয়ে তাদেরকে নিরাপদে নিয়ে আসার চিন্তা করছিল কিন্তু সমস্যা হয়েছে যে এখন কারফিউ লাগিয়ে দিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার, বোধহয় আটচল্লিশ ঘণ্টার… এখন ত্রিলোচনও কিছু করতে পারছে না। আশেপাশে সবাই মুসলমান, বেশ ভয়ংকর মুসলমান। আর পাঞ্জাব থেকে খবর আসছে যে ওখানে শিখরা মুসলমানদের ওপর অনেক অত্যাচার করছে। যেকোনো হাত… মুসলমানের হাত কৃপাল কৌরের নরম আর কমনীয় হাত ধরে তাকে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে নিয়ে যেতে পারে।
Reviews
There are no reviews yet.